অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

  ০৮ জুন, ২০২৩

সংবাদ সম্মেলনে ডিএসই চেয়ারম্যান

বাজেটে নতুন কিছু না পেলেও বড় কিছু হারাইনি

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

গত ১ জুন প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে পুঁজিবাজারে কোন প্রকার সুবিধা প্রদান করা হয়নি। এমনকি বাজেট উত্থাপনের পরদিন সংবাদ সম্মেলনেও পুঁজিবাজার নিয়ে কোন আলোচনা করেননি অর্থমন্ত্রী। ফলে খাত সংশ্লিষ্ট সকলের মত, বাজেটে পুঁজিবাজার উপেক্ষিত হয়েছে। তবে এমনটা মনে করেন না ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হাফিজ মুহম্মদ হাসান বাবু। বরং খাত সংশ্লিষ্টদের হতাশ না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাজেটে আমরা নতুন কিছু না পেলেও আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি। বড় কিছু হারাইনি। রাজধানীর একটি হোটেলে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এই কথা বলেন ডিএসই চেয়ারম্যান। তিনি পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ৭টি দাবিও পেশ করেন।

ডিএসই চেয়ারম্যান বলেন, আপনারা হতাশ হবে না। শেয়ার মার্কেট বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল হাতিয়ার হবে, এই বিশ^াস রাখেন। তিনি বলেন, বাজেটে নতুন কিছু না পেলেও বড় কিছু হারাইনি। বরং সুযোগ আছে নতুন কিছু করার। অধ্যাপক হাসান বাবু বলেন, ১৯৭১-এ শূন্য হাতে এই বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল, এখন ২০২৩ সালে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। আমরা আরো এগিয়ে যাবো। বাজেটের আগে শুনেছিলাম এখানে করারোপ করা হবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমনটা হয়নি। সেক্ষেত্রে বলা যায় বাজেটে আমাদের জন্য তেমন কিছু না থাকলেও বড় কিছু হারাইনি আমরা।

এসময় পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বন্ড থেকে সুদ আয়ের ওপর কর অব্যহতি ও লভ্যাংশের উপর আরোপিত উৎস কর প্রত্যাহারসহ সরকারের নিকট সাতটি দাবি পুনর্বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করেন ডিএসই চেয়ারম্যান। এগুলো হলো- বন্ড থেকে সুদের আয়ের উপর কর অব্যহতি ও বন্ডে বিনিয়োগে কর রেয়াত সুবিধা, কোম্পানির লভ্যাংশ আয়ের উপর ধার্যকৃত উৎসে কর সম্পূর্ণ এবং চূড়ান্ত নিষ্পত্তিমূলক কর হিসেবে বিবেচনাকরণ, স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের উপর অর্পিত উৎস করের হার কমানো, এক্সচেঞ্জের মূল বোর্ডে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার হ্রাস, এক্সচেঞ্জে এসএমই বোর্ডের অধীনে তালিকাভুক্ত এসএমই কোম্পানিগুলোর জন্য হ্রাসকৃত হারে কর আরোপ, তালিকাভুক্ত কোম্পানির ভ্যাট হার হ্রাস করা এবং বহুজাতিক কোম্পানিকে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে উৎসাহিত করা ও বর্তমানে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারের পরিমাণ বৃদ্ধি করা।

এসব দাবির পক্ষে ডিএসই’র পক্ষ থেকে যে যুক্তি তুলে ধরা হয়, সেগুলো হলো-

বন্ড থেকে সুদের আয়ের ওপর কর অব্যাহতি : বর্তমানে কর্পোরেট বন্ডের বাজারের আকার খুবই ছোট যা পুঁজিবাজারের পাশাপাশি অর্থ বাজারেও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা তৈরি করেছে। একটি কার্যকরী বন্ড বাজার অর্থনীতিকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে পারে। এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত বন্ডের উপর অর্জিত সুদকে কর আওতামুক্ত রাখতে হবে এবং বন্ডের বিনিয়োগকে কর রেয়াতের আওতাভুক্ত করা প্রয়োজন। তাহলে বাংলাদেশের বন্ড মার্কেট আকর্ষনীয় ও শক্তিশালী হবে এবং সেই সাথে সরকার এবং উদ্যোক্তারাও বন্ডের মাধ্যমে দীর্ধমেয়াদি ফান্ড সংগ্রহ করতে উৎসাহিত হবে।

কোম্পানির লভ্যাংশ আয়ের উপর ধার্যকৃত উৎসে কর সম্পূর্ণ এবং চূড়ান্ত নিষ্পত্তিমূলক কর হিসেবে বিবেচনাকরণ : কোম্পানির লভ্যাংশের উপর কর এক ধরনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের করারোপণ। কোম্পানির লভ্যাংশ আয়ের উপর ধার্যকৃত উৎসকর ধারা ৮২-সি অনুযায়ী চূড়ান্ত কর দায় হিসেবে বিবেচিত হলে বিনিয়োগকারীগণ বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে।

স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের উপর অর্পিত উৎস করহার হ্রাস : বর্তমানে স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেনের উপর উৎসকর ০.০৫ শতাংশ, যা বিনিয়োগকারীদের লেনদেন ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। লেনদেনের উৎসকর ০.০৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.০১৫ শতাংশ করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে লেনদেন খরচ কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা বেশি পরিমাণ লেনদেনে উৎসাহী হবে এবং সরকার অধিক পরিমানে রাজস্ব আয় করবে।

এক্সচেঞ্জের মূল বোর্ডে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার হ্রাস করা : ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় কর্পোরেট কর হারে কোন পরিবর্তন আনা হয়নি। বর্তমানে এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত যে সব কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে তাদের পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশী শেয়ার ছেড়েছে, সেসব কোম্পানির ক্ষেত্রে কর্পোরেট কর হার ২০ শতাংশ। আর যে সব কোম্পানি আইপিওতে তাদের পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের কম শেয়ার ছেড়েছে, তাদের ক্ষেত্রে কর্পোরেট কর হার ২২.৫০ শতাংশ। অর্থাৎ এক্ষেত্রে করহারের পার্থক্য মাত্র ২.৫০ শতাংশ।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির এবং অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর্পোরেট কর হারের পার্থক্য ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করছি। তাহলে কর সুবিধা নেওয়ার জন্য, অধিক সংখ্যক কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করবে। যা পুঁজিবাজারকে আরো শক্তিশালী ও গতিশীল করবে। এছাড়াও হ্রাসকৃত কর হারের ফলে ভালমানের কোম্পানিগুলো স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হতে উৎসাহিত হবে।

এক্সচেঞ্জের এসএমই বোর্ডের অধীনে তালিকাভুক্ত এসএমই কোম্পানিগুলোর জন্য হ্রাসকৃত হারে কর আরোপ: ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড-এ তালিকাভুক্ত এসএমই কোম্পানির কর্পোরেট কর হার ও অ-তালিকাভুক্ত এসএমই কোম্পানির কর হারের পার্থক্য ন্যূনতম ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করছি যা অ-তালিকাভুক্ত কম্পানিকে এক্সচেঞ্জের এসএমই প্লাটফর্ম এ তালিকাভুক্তির জন্য উৎসাহিত করবে এবং তাতে দীর্ঘমেয়াদে সরকারের কর আদায় বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে কোম্পানির অর্থায়নের জন্য ব্যাংকিং সেক্টর এর উপর চাপ কমবে এবং ব্যাংকের নন পারফর্মিং লোনের পরিমানও কমে আসবে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ৯৭ শতাংশ হলো এসএমই খাত। ভারতের এসএমই খাত জিডিপির ১৫ শতাংশ তথ্য প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের এসএমই খাত জিডিপির ২৪.৪৫ শতাংশ তথা মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলার। এসএমই মার্কেট ক্যাপিটেল হলো ১২.৬৮ বিলিয়ন এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ১৬টি। যা মূল মার্কেটি ক্যাপিটেলের মাত্র ০.১৬ শতাংশ ও মোট তালিকাভুক্ত কোম্পানির ৪.৩০ শতাংশ।

তালিকাভুক্ত কোম্পানির ভ্যাট হার হ্রাস করা : বর্তমানে তালিকাভুক্ত এবং অ-তালিকাভুক্ত উভয় কোম্পানীর ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ। তালিকাভুক্ত কোম্পানির ভ্যাট হার হ্রাস। করে ১৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করার জন্য সুপারিশ করছি। তাতে করে সরকারের ভ্যাট থেকে প্রাপ্ত মোট রাজস্ব হ্রাস পাবে না। বর্তমানে বহুপ্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা আছে তালিকাভুক্ত না হয়ে বিভিন্নরূপ সুবিধা ভোগ করছে। পুঁজিবাজারের গতিশীলতা ও রাজস্ব বেশী পরিমানে আদায়ের লক্ষ্যে তালিকাভূক্ত কোম্পানীর ভ্যাট হার হ্রাস করার জন্য সুপারিশ করছি।

বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্তকরণ উৎসাহিতকরণ এবং বাজারে বিদ্যমান তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারের পরিমান বাড়ানো : পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সহ অন্নান্য সকল উন্নত দেশের পুঁজিবাজারে বহুজাতিক কোম্পানিকে তাদের মোট শেয়ারের নূন্যতম ১০ শতাংশ তালিকাভুক্ত করা বাধ্যতামুলক, অন্যথায় সেই সকল কোম্পানি সেই দেশে ব্যবসা করার অনুমতি পায় না। আমাদের দেশেও পুঁজিবাজার উন্নয়নকল্পে এইরুপ আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগ অতীবও জরুরী। বর্তমানে আমাদের দেশের পুজিবাজারে যে সকল বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্ত আছে সেগুলোর বেশিরভাগেরই বাজারে শেয়ারের সংখা অত্যান্ত কম। অল্পকিছু শেয়ার বাজারে ছেড়ে তারা সরকারের কাছ থেকে বড় ধরনের কর সুবিধা পেয়ে আসছে। বাজারে গভীরতা বৃদ্ধি ও পুজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আরো বেশি বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়া অত্যান্ত জরুরি এবং সেই সাথে বিদ্যমান তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার স্যাংখাও বাড়াতে হবে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড মনে করে, সরকারের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে উপরে উল্লেখিত বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত। করলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং জাতীয় অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে। এতে বেসরকারিখাত আরো শক্তিশালী ও বিকশিত হয়ে দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরকে আরো বেশি আকৃষ্ট করবে।

ডিএসই চেয়ারম্যান আশা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কাছে জমা দিয়েছি। আশা করছি, পুঁজিবাজারের স্বার্থে আমাদের প্রস্তাব বিবেচনা করবে।

সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন স্বতন্ত্র পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন ও রুবাবা দৌলা, ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডিএসইর সিএফও ও ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাত্তিক আহমেদ শাহ, সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার সামিউল হক এবং আসাদুর রহমান।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ডিএসই চেয়ারম্যান,বাজেট
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close