জাহিদুল ইসলাম
কয়েকটি বিমা কোম্পানি বন্ধ হওয়ার তথ্য উদ্দেশ্যমূলক

সরকারের নানান পদক্ষেপের পরও দেশের বিমা খাতের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। কোম্পানিগুলোর নানা অনিয়ম ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল নজরদারিকেই এজন্য দায়ী করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। এমনকি কোম্পানিগুলো এই অনিয়মে খোদ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা দেখেও না দেখার ভান করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি অনিয়মের দায়ে কয়েকটি বিমা কোম্পানির ব্যবসা বন্ধ হতে পারে এমন তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ায় আতঙ্ক তৈরি হয় এই খাতে। পাশাপাশি খাত-বিশ্লেষকদের মধ্যে এমন তথ্য প্রকাশ নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের কারণে দুর্বল হয়ে পড়ছে দেশের অধিকাংশ বিমা কোম্পানি। যেখানে শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া দেশে জিডিপিতে বিমা খাতের অবদান ১.৩ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের মাত্র ০.৫ শতাংশ। এশিয়ার প্রায় সব দেশ এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। সুইস রি-ইন্স্যুরেন্সের তথ্য মতে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ বিমা পেনিট্রেশনে ৮৮টি দেশের মধ্যে ৮৬তম অবস্থানে। চরম মূল্যস্ফীতিতে থাকা পাকিস্তানেরও বিমা পেনিট্রেশনের হার ০.৭। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা ১.৩ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ১.৬, চীন ৩.৯, প্রতিবেশী ভারত ৪.২, মালয়েশিয়া ৫.৩, থাইল্যান্ড ৫.৪, জাপান ৮.৪, তাইওয়ান ১৪.৮ এবং হংকং-এ ১৯.৬ শতাংশ জিডিপি পেনিট্রেশন রয়েছে।
মূলত আইন ও বিধি মোতাবেক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় ব্যর্থতাই এসবের মূল কারণ বলে জানান খাত-সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি আইডিআরএর নজরদারির ব্যর্থতা ও সংস্থাটির কিছু কর্মকর্তার দুর্বলতার কারণেই দেশের বিমা খাত এমন অবহেলিত বলে মনে করেন তারা।
সম্প্রতি কয়েকটি অনলাইন পোর্টাল আইডিআরএ সূত্রের বরাত দিয়ে তথ্য প্রকাশ করেছে, প্রায় ১২টি বিমা কোম্পানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে বলা হয়েছে, দুর্বল বিমা কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে চাপ রয়েছে। দুর্বল আর্থিক অবস্থা, বিনিয়োগে অনিয়ম, ব্যবস্থাপনায় মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়, গ্রাহক দাবির টাকা পরিশোধে ব্যর্থতা, লাইফ ফান্ডে টাকা না থাকা, মাত্রাতিরিক্ত কমিশন প্রদান ইত্যাদি কারণে এসব কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য চাপ রয়েছে।
কিন্তু বিমা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, দেশীয় বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে শীর্ষে যারা, তারাও গ্রাহকের দাবি পরিশোধে দীর্ঘসূত্রতা করছে। এমনকি ৫-৬ বছর পেরিয়ে গেলেও এসব কোম্পানির অনেক গ্রাহক টাকা পাননি। বিভিন্ন সময়েই ওই কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে গ্রাহকের মানববন্ধন, মিছিলসহ বিভিন্ন ক্ষোভের কথা মিডিয়াতে দেখা যায়। কিন্তু এ নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো বিকার নেই। অভিযোগ উঠেছে, পুরোনো বিমা কোম্পানিগুলো নিজের নানান সমস্যা আড়ালে রাখতে আইডিআরএর মাধ্যমে চতুর্থ প্রজন্মের কোম্পানিগুলোয় বিশেষ নিরীক্ষা চালিয়েছে। অথচ ওইসব কোম্পানি ৪-৫ বছরেও গ্রাহকের দাবি পরিশোধ করতে পারছে না।
চতুর্থ প্রজন্মের কয়েকজন সিইও বলেন, ২০১৩-১৪ সালে অনুমোদন পাওয়া সবগুলো বিমা কোম্পানিই কার্যক্রম পরিচালনায় ম্যানুয়েলের পরিবর্তে ডিজিটাইজেশনের পথে হাঁটছে। ফলে এসব কোম্পানির যেকোনো অনিয়ম ধরা সহজ। ফলে কোম্পানিগুলোর অনিয়ম করার সুযোগ তেমন নেই। একটু লক্ষ করলে দেখবেন, চতুর্থ প্রজন্মের প্রায় সব কোম্পানিই গ্রাহকদের দাবি সময়মতো দিচ্ছে। দু-একজন ছাড়া কারো বকেয়া দাবি নেই। এই খাতে অনিয়মগুলো শুরু হয়েছে পুরোনো কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে। তাদের অনিয়মের খেসারত এখন পর্যন্ত আমাদের দিতে হচ্ছে।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমা খাতে সরকারের নানামুখী উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ সত্ত্বেও এখনো গ্রাহক দাবি প্রদানে হয়রানি বন্ধ হয়নি। এ ক্ষেত্রে কোম্পানি বন্ধ নয় বরং আইডিআরএর উচিত আইন ও বিধিগুলো পরিপালন বিষয়ে কঠোরভাবে মনিটরিং করা। তাহলেই এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসতে পারে। পাশাপাশি এই খাতের কোনো কোম্পানিকে বাড়তি সুবিধা না দিয়ে সবাইকে সমান চোখে দেখা।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে বিমা কোম্পানি বন্ধের কোনো নজির নেই। বরং কোম্পানির পরিস্থিতি খারাপ হলে সেখানে আইনানুসারে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অথবা অন্য কোম্পানির সঙ্গে একীভূত করতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলে পুরো খাত নাজুক পরিস্থিতিতে পড়বে। বন্ধ হলে এসব কোম্পানির গ্রাহকরা আরো অস্থিরতায় পড়বেন টাকাপ্রাপ্তি নিয়ে। যেসব কোম্পানির বন্ধ হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে, দেশজুড়ে তাদের লাখ লাখ গ্রাহক রয়েছে। এই ক্ষেত্রে বন্ধ হওয়ার তথ্যে তারা কোম্পানির শাখা কার্যালয়, প্রধান কার্যালয়সহ নিয়ন্ত্রক সংস্থায় হুমড়ি খেয়ে পড়বে পাওনা টাকা আদায়ে। এসব ঘটনা মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসীকে খারাপ বার্তাই দেবে। একই সঙ্গে অন্য কোম্পানিগুলোও ব্যবসা চালাতে দুর্ভোগে পড়বে।
তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সূত্রের বরাতে বিমা কোম্পানি বন্ধের এমন তথ্য প্রকাশ উদ্দেশ্যমূলক কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দ্বিতীয় প্রজন্মের সাধারণ বিমা এবং চতুর্থ প্রজন্মের জীবন বিমা কোম্পানির কয়েকজন ঊর্ধ্বতন জানান, কয়েকজন গণমাধ্যম বন্ধুর কাছে শুনেছি যে আইডিআরএ থেকে তথ্য পাওয়া যায় না। সেই তারাই নাকি একটি কোম্পানির ব্যবসা বন্ধের সংবাদ পরিবেশনে ব্যক্তিগতভাবে সংবাদকর্মীদের দিয়েছেন। এরপর আবার প্রায় ১২টি কোম্পানি বন্ধের এমন তথ্য। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কি আর্থিক খাতে সরকারের সহযোগী হচ্ছেন নাকি, এমন তথ্য ছড়িয়ে খাতটির সর্বনাশ ডাকছেন সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
প্রায় একই কথা বলছেন অবসরে যাওয়া এই খাতের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমনটাই মনে হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করতে চাইছেন। এ ক্ষেত্রে আইডিআরএর সাবেক ঊর্ধ্বতনদের মতো তারাও ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছেন কি না সেটা দেখতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে আইডিআরএর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন তারা। তাদের বক্তব্য হলো, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেছেন বিমার টাকার জন্য মানুষ রাস্তায় নামবে, মিছিল করবে। বিমা খাতের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণের ভার যার হাতে, তার থেকে এমন বক্তব্য প্রত্যাশিত নয়। এ বক্তব্য ঘিরে বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া গত বিমা দিবসে কয়েকটি কোম্পানিকে পুরস্কৃত করা নিয়েও বিতর্ক আছে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হিসেবে দেশের আর্থিক খাতে শেখ কবির হোসেন অবদান রাখায় তিনি পুরস্কার পেতে পারেন, কিন্তু সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স এমন কিছু করেনি যে তাকে পুরস্কৃত করতে হবে। বরং এই কোম্পানির চেয়েও অনেক গুণ ভালো আর্থিক অবস্থা ও নিয়ম পরিপালনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এ ছাড়া জীবন বিমায় পুরনো অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা গ্রাহকের বিমা দাবি বছরের পর বছর দিতে পারছে না। সেসব কোম্পানির ব্যবসা বন্ধ না করে বলা চলে নতুন একটি কোম্পানির বিমা ব্যবসা সংগ্রহ বন্ধ করে দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক? অনেক কোম্পানি আছে যেখানে সিইওদের পর্যাপ্ত শিক্ষাগত যোগ্যতাই নেই। জাল সনদ প্রমাণের পরও দেদার প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থা সব জেনেও নীরব আছে। তারা জরিমানাও দিচ্ছেন আবার বেতন-ভাতাও নিচ্ছেন। অনেক কোম্পানি ইচ্ছা অনুযায়ী পদ সৃষ্টি করে সেই পদে নিয়োগ দিয়ে বেতন-ভাতা দিচ্ছেন। আইডিআরএর নির্দেশিত সাংগঠনিক পদ স্তর (অরগানোগ্রাম) মানছেন না। এমনকি অর্থের বিনিময়েও সিইও পদে অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে আইডিআরএর বিরুদ্ধে।
গুঞ্জন রয়েছে বর্তমানে আইডিআএর শীর্ষ কর্মকর্তারা বিমা কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে সম্মানী বাবদ নগদ অর্থ গ্রহণ করছেন। সাম্প্রতিককালে সংস্থাটির একজন সদস্য একটি চতুর্থ প্রজন্মের বিমা কোম্পানি থেকে উপহারস্বরূপ আইফোন নিয়েছেন। এ ছাড়া অন্য এক সদস্য ফ্যামিলি ট্যুরে রাজশাহী গেলে সেই ভ্রমণের যাবতীয় খরচ ব্যয় করেছে একটি শীর্ষস্থানীয় বিমা কোম্পানি। এ ছাড়া একটি কোম্পানির সিইও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে আইডিআরএর এক সদস্যকে যুক্তরাষ্ট্রে আনা-নেওয়াসহ যাবতীয় খরচ নির্বাহ করায়।
উল্লেখ, ২০১৯ সালে বিমা কোম্পানিগুলোর বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে হঠাৎই বন্ধ করে দিয়েছিল আইডিআরএ। অভিযোগ রয়েছে, সে সময় এই অডিট প্রতিবেদন নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির সথেঙ্গ দেন-দরবার করতেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু কর্মকর্তা। এ কর্মকর্তাদের অনেকেই এখনো সংস্থাটিতে কর্মরত।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিচালক ও মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইডিআরএ কেন আতঙ্ক তৈরি করবে? আতঙ্ক তৈরি করা তো আইডিআরএ’র কাজ নয়। তবে গ্রাহক দাবির টাকা পেতে যেন ভোগান্তির শিকার না হন, সে জন্য বিভিন্নভাবে আইডিআরএ চাপ তৈরি করতে পারে; সেটা গ্রাহকের স্বার্থে। তবে কর্তৃপক্ষের এমন কোন চিন্তা-ভাবনা নেই যে, কোন কোম্পানিকে বন্ধ করে দেবে। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, বর্তমান চেয়ারম্যান অত্যন্ত সৎ ও কর্মঠ লোক। গ্রাহকের স্বার্থে বিমা কোম্পানিকে চাপ দিতে পারেন, কিন্তু এখানে অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। বরং অন্যান্য চেয়ারম্যানের চেয়ে তিনি শক্ত অবস্থানের ও ভালো মানসিকতার লোক।
পিডিএসও/এমএ