নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকার আবাসন ব্যবস্থা : ফ্ল্যাটের দাম আকাশ ছুঁইছুঁই, বেড়েছে বাড়িভাড়াও
দফায় দফায় বাড়ছে সবধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম। নানা কারণ দেখিয়ে বেড়েছে রড-সিমেন্টের দামও। বর্তমানে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে এসব নির্মাণসামগ্রী। অন্যদিকে, নতুন ড্যাপে ঘোষিত ফ্লোর-এরিয়া রেশিও বা আয়তন অনুপাতে তলা কমানোর কারণে ঢাকায় বেশিরভাগ ভবনের অনুমোদন হচ্ছে চার থেকে পাঁচ তলা। ফলে ফ্ল্যাট নির্মাণ খরচ পড়ছে বেশি। ফলে ফ্ল্যাটের দামও আকাশ ছুঁইছুঁই করছে। এতে কমে গেছে ফ্ল্যাটের বিক্রি; বেড়েছে বাড়িভাড়া। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
আবাসন খাত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সবধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম হু-হু করে বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে নতুন নির্মাণ করা ফ্ল্যাটে। ফলে এলাকা এবং নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ভেদে ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের দাম ১ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এ দাম আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কাও করা হচ্ছে।
দেখা গেছে, গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই ঊর্ধ্বগতির ধারা ছিল নির্মাণসামগ্রীর অন্যতম উপকরণ রড-সিমেন্টের। এরপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর কয়েক মাসের ব্যবধানে আবারও রডের দাম বাড়তে থাকে। সে সময় রডের দাম প্রতি টনে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৯৩ থেকে ৯৫ হাজার টাকায়। এরপরও রডের দামের ঊর্ধ্বগতি থামেনি, বর্তমানে প্রতি টন রডের দাম গিয়ে ঠেকেছে ১ লাখ ১ হাজার টাকায়। অর্থাৎ কয়েক মাসে রডের দাম প্রতি টনে বেড়েছে প্রায় ৮ হাজার টাকা।
এদিকে, সিমেন্টের দামও বেড়ে বস্তাপ্রতি ৫৫০ থেকে ৬৬০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে প্রথম শ্রেণির অধিক পোড়া ইটের প্রতিটির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ টাকা আর অটোমেটিক মেশিনে তৈরি এক নম্বর ইটের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ টাকায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে এসব উপকরণের কাঁচামালের দাম বেড়েছে, এর মধ্যে ডলারের প্রভাব রয়েছে, রয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবও। সবমিলিয়ে বেড়েছে এসব নির্মাণ উপকরণের দাম।
জানা গেছে, রাজধানীর লালমাটিয়া এলাকায় যে ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুট আগে ১২ থেকে ১৮ হাজার টাকা ছিল, সেটি বেড়ে এখন ১৫ থেকে ২০ হাজার বা তারও বেশি হয়েছে। একইভাবে ধানমন্ডি এলাকায় যে ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুট ১৮ হাজার টাকা ছিল, সেটির দাম বর্তমানে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার বেশি। মিরপুর এলাকার ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুট ৫ হাজার থেকে বেড়ে ৬/৭ হাজার টাকার বেশি হয়েছে। কয়েক বছরে ফ্ল্যাটের সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে রাজধানীর বারিধারা, গুলশান, ধানমন্ডি এলাকায়।
রাজধানীর মালিবাগ এলাকার একটি রড-সিমেন্টের দোকানের মালিক আবদুুস সোবহান বলেন, কয়েকদিন আগেও রড বিক্রি করেছি প্রতি টন ৯৪ হাজার টাকায়। এখন সেটি বিক্রি করতে হচ্ছে ১ লাখ ১ হাজার টাকায়। একইভাবে সিমেন্টের দামও বাড়তি যাচ্ছে। আসলে এসবের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের ব্যবসা কমে গেছে। কারণ, নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে মানুষ এখন বাড়ির কাজ শুরু করছে না। ফলে আমাদের বিক্রিও কমে গেছে। ঠিকাদার, আবাসন ব্যবসায় জড়িত অনেকেই আমার কাছ থেকে মালামাল নেন। তারাও বলছেন, আগে যেসব কাজ শুরু হয়েছিল সেগুলোরই কাজ চলছে এখনো। বাড়তি দামে সবকিছু কিনে কাজ করতে হচ্ছে, তাই ফ্ল্যাটের দামের পাশাপাশি ভাড়াও বাড়ছে।
এ বিষয়ে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) বলছে, নতুন ড্যাপে ঘোষিত ফ্লোর-এরিয়া রেশিও বা আয়তন অনুপাতে তলা কমানোর কারণে ঢাকায় বেশিরভাগ ভবন হবে ৪ থেকে ৫ তলা। ফলে আগামীতে আবাসন সংকট আরো প্রকট হবে। উচ্চহারে ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে এবং বাড়ি ভাড়া আকাশচুম্বী হবে।
রিহ্যাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নতুন ড্যাপের কারণে ফ্ল্যাটের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে। নতুন ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর থেকে আবাসন কোম্পানিগুলো জমির মালিকের সঙ্গে কোনো চুক্তি বা সমঝোতায় যেতে পারছে না। কেউ নতুন করে প্ল্যান পাস করছে না। পুরনো প্রকল্পগুলো নিয়েই অনেকে কাজ করছে। ফলে আগামীতে ফ্ল্যাটের সংকট তৈরি হবে এবং দাম বাড়বে।
এদিকে, আগে যেখানে প্রশস্ত রাস্তা না থাকলেও ৮/১০ তলা ভবন করা যেত সেখানে নতুন ড্যাপের নিয়ম অনুযায়ী অনুমোদন পাওয়া যাবে ৪/৫ তলা ভবনের। এ কারণে স্বল্প প্রশস্তের রাস্তার পাশের জমির মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছেন। আর আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে বাসা, ভবন নির্মাণ করছে না আগের মতো।
আবাসন কোম্পানিগুলো তথ্যমতে, প্রতি বছরই ফ্ল্যাটের চাহিদা বাড়ছে, আর নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির ফলে ফ্ল্যাটের দামেও প্রভাব পড়ছে। ফলে এলাকাভেদে নতুন ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের দাম ১ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে এই দাম আরো বাড়তে পারে।
এ বিষয়ে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, আগে যেখানে আটতলা ভবনের অনুমোদন পাওয়া যেত, নতুন ড্যাপের কারণে সেখানে অনুমোদন পাওয়া যাবে চারতলা বাড়ির। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই আবাসন কোম্পানিগুলো কম প্রশস্তের রাস্তার পাশে যেসব জমি আছে সেসব জমির মালিকদের সঙ্গে ফ্ল্যাট বা বাড়ি নির্মাণের কোনো চুক্তি করছে না। ফলে নতুন করে বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে না। কারণ এখানে আবাসন কোম্পানি, জমির মালিক দুপক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যে কারণে চাহিদার তুলনায় ফ্ল্যাট নির্মাণ হচ্ছে না। এজন্য ফ্ল্যাটের দামও বাড়ছে। এছাড়া নির্মাণসামগ্রীর অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির কারণেও ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, একটি ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুট নির্মাণের ক্ষেত্রে আবাসন কোম্পানিগুলোর খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যে কারণে ক্রেতাদের কাছে বেশি দামে ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি করতে হচ্ছে।
তবে ড্যাপ পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, শুধু ফ্লোর এরিয়া কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, এটা নয়। বিশ্বের অন্যান্য শহরে প্লটকেন্দ্রিক উন্নয়ন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আমরাও তা-ই করেছি। যে এলাকার পরিষেবা উন্নত, সে এলাকায় ফ্লোর এরিয়া রেশিও বেশি হবে। এ নিয়ম অন্যান্য দেশেও রয়েছে, সে তুলনায় আরো বেশি তলার অনুমোদন আমরা দিয়েছি ড্যাপে। এছাড়া নতুন ড্যাপে গণমানুষের আবাসনের বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বল্প আয়ের আবাসনকে নীতিপ্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি নাগরিক সুবিধা প্রদান করে সবার জন্য মানসম্মত আবাসন নিশ্চিত করাই আমাদের উদ্দেশ্য।