নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

সরকারের নানামুখি পদক্ষেপ

কমেছে আমদানি ব্যয় ও বাণিজ্য ঘাটতি

ফাইল ছবি

সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয় কমেছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয়েও উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। আর এতে বৈদেশিক বাণিজ্যে স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে। কমতে শুরু করেছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) ঘাটতি। বাণিজ্য ঘাটতিও কমছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২৭ বিলিয়ন (৫২৭ কোটি) ডলার। এক মাস আগে জুলাই-নভেম্বর সময়ে এই ঘাটতি ছিল বেশি, ৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) ঘাটতি ছিল আরও বেশি, ৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।

আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছর। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই কোনো অর্থবছরে ব্যালান্স অব পেমেন্টে এত ঘাটতি দেখা যায়নি। তার আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে এই সূচকে ৪ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি ছিল।

অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ কমেছে ঠিক। কিন্তু সামগ্রিক হিসাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি ব্যয় এখনো বেশি। সে কারণে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ ইতিবাচক ধারায় ফিরলেও ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি রয়েই গেছে। তবে আমদানি ব্যয়ের যে ধারগতি এখন রয়েছে, সেটা যদি থাকে আর রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স যেভাবে বাড়ছে সেটা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে এবার ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি গতবারের মতো অত বেশি হবে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের আগস্ট থেকে আমদানি ব্যয় বাড়তে শুরু করে। পুরো অর্থবছরে সেই উল্লম্ফন দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়েও উল্লম্ফন হয়েছিল; ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। সে কারণেই ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি চূড়ায় উঠেছিল।

এবার আমদানি ব্যয়ে ধীরগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় কমেছে ২ দশমিক ১৫ শতাংশ। আর রপ্তানি আয় বেড়েছে ১১ শতাংশের বেশি।

গত অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে পাহাড়সম ঘাটতি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল মন্তব্য করে অর্থনীতির বিশ্লেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, ‘ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি কমে এলে অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসবে। ডলারের বাজারেও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।’

বেশ কয়েক বছর পর ২০২০-২১ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ওই বছর। তার আগে ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।

বাণিজ্য ঘাটতি ২১.৭১ শতাংশ : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই ছয় মাসে বাংলাদেশ রপ্তানির চেয়ে ১২ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য আমদানি করেছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের এই ছয় মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ এর চেয়ে বেশি ছিল, ১৫ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। শতাংশ হিসাবে অর্থবছরের প্রথমার্থে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ কমেছে ২১ দশমিক ৭১ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ৩৮ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ১৫ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই ছয় মাসে ৩৮ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। অন্যদিকে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ২৫ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ বেশি। গত বছরের এই পাঁচ মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ২৩ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল। এ হিসাবেই অর্থবছরের প্রথম ছয় পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

রেমিট্যান্স বেড়েছে ২.৪৭ শতাংশ : গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম। তবে এবার এই সূচকে উল্লম্ফন নিয়ে অর্থবছর শুরু হয়েছিল। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়। ওই দুই মাসেই দেড় বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অথচ প্রথম দুই মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি করে পাঠিয়েছিলেন। তবে নভেম্বর থেকে রেমিট্যান্স ফের বাড়তে শুরু করেছে। নভেম্বরে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আ.লীগ সরকার,কেন্দ্রীয় ব্যাংক,রপ্তানি আয়,বাণিজ্য ঘাটতি,বাংলাদেশ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close