গাজী শাহনেওয়াজ
চিনির দামে বেকায়দায় চা দোকানিরা
সুস্বাদু খাবার রান্না থেকে শুরু করে চায়ের দোকান সর্বত্রই চাহিদা রয়েছে চিনির। কিন্তু এই চিনি এখন দুষ্প্রাপ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে। রমজান মাস আসন্ন। এর আগেই বাজার থেকে উধাও চিনি। কিছু মিললেও দাম চড়া। চিনির অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে চা বিক্রেতাদের (টি-স্টলে) মধ্যে নেমে এসেছে বিপর্যয়। কারণ এক কেজি চিনি ১১০-১১৫ টাকায় কিনতে গিয়ে তাদের নাভিশ্বাস। এই পরিস্থিতিতে বেদায়দায় পড়েছেন চা দোকানিরা।
জানা গেছে, অনেকের ব্যবসায়িক মুনাফা খেয়ে খেলছে বর্ধিত চিনির মূল্য। একই ভাবে ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সমন্বয় না হওয়ায় লোকসানের কবলে এ শ্রেণির ক্ষুদ্রু ব্যবসায়ীরা। আবার দাম সমন্বয় করতে গিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে চলছে বাক-বিতন্ডা। না বাড়ালেও লোকসানের কবলে পড়ে দোকান গুটানোর পর্যায়ে অনেক দোকানি।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, খোলা চিনি কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ১০৭ টাকা কেজি। প্যাকেটজাত চিনির দাম প্রতি কেজি ১১২ টাকা। সরকার নির্ধারিত এই দাম আগামীকাল (১ ফেব্রুয়ারি) থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু দোকানদাররা ইতিমধ্যে বাড়তি দাম কার্যকর করে ফেলেছে। তারা অবশ্য তাদের মতো করে দাম রাখছে। এক কেজি চিনির দোকানভেদে ১১০-১১৫ টাকা, আবার কোথাও কোথাও ১২০ টাকায় বিক্রি করছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের কথা বললে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না তারা। ব্যবসায়ী, খুচরা দোকানি, চা-দোকানি থেকে অর্থনীতিবিদ সবাই একটাই বক্তব্য, আসলে বাংলাদেশে সরকারি দামের কোনো কার্যকারিতা খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না।
এক বছর আগেও প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাধার পর থেকেই বাড়তে থাকে চিনির দাম। এই যুদ্ধের সঙ্গে চিনির দাম বাড়ার আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কি না এ নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। তবে প্রতিনিয়ত বাড়ছে এটাই বাস্তবতা। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, তা অকপটে স্বীকার করেছেন ব্যবসায়ী থেকে শুরু চা দোকানের বিক্রেতা।
পুষ্টিবিদ রবিয়া রতি বলেন, চিনির বিকল্প যত কিছুই আসুক না কেন চিনির মতো প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি বস্তু মানবদেহের জন্য খুবই জরুরি। বাংলাদেশের মানুষ এমনিতেই নানা রকম অপুষ্টিতে ভোগে। তাই চিনির অভাব হলে শরীরে অনেক রকম ঘাটতি হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সব কথার মূল কথা চিনির বাজারের আগুন নেভাতে হবে। দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতেই হবে, উৎপাদন বাড়িয়ে হোক কিংবা আমদানি বাড়িয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের বার্ষিক চিনির চাহিদা প্রায় ২০ লাখ মেট্রিকটন। দেশের চিনিকলগুলোতে চাহিদার মাত্র ২০ ভাগের এক ভাগ উৎপাদন হয়। বেশিরভাগ সরকারি চিনিকলে লোকসানের কারণে সরকার অধিকাংশ চিনিকল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। একমাত্র কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড এখনও ঠিকঠাক উৎপাদন করছে। ফলে এই কলটিতে লোকসান নেই বলে জানা গেছে।। কিন্তু সরকারি তথ্যানুযায়ী চাহিদার মাত্র চার শতাংশ পূরণ করতে পারে, যার পরিমাণ মাত্র ৮০ হাজার মেট্রিক টন। চাহিদার বাকি ১৯ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন চিনি আমদানি করতে হয়। অথচ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া চিনিকলগুলো ব্যবসাসফল।
এক বছর আগেও প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাধার পর থেকেই বাড়তে থাকে চিনির দাম। এই যুদ্ধের সঙ্গে চিনির দাম বাড়ার কোনো সম্পর্ক আছে কি না এ নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ব্যবসায়ী বলেন, 'গাড়ি ভাড়া, লেবারসহ অন্যান্য খরচ মিলে প্রতি কেজির দাম পড়েছে ১১৪ টাকা। সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করলে প্রতি কেজিতে আমার ৪ টাকা লস হবে। আমি তো আর লস করে কিছু বিক্রি করতে পারব না। যার কারণে আমার স্থায়ী ক্রেতা ছাড়া আর কারো কাছে চিনি বিক্রি করছি না।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, চিনির দাম বাড়ার তেমন কোনো কারণ আছে বলে সাধারণ মানুষের জানা নেই। যারা বাড়িয়েছেন তারাও জানেন কি না সন্দেহ। বাংলাদেশে ১৫টি সরকারি চিনিকল আছে। এসব কলে বছরে কয়েক হাজার টন চিনি উৎপাদন হয়। এই চিনি দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানিও করার কথা। চিনিকলগুলোর অবস্থা আসলে এতটাই নাজুক যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। যেসব কলে প্রচুর চিনি উৎপাদিত হচ্ছে সেসব চিনিও জানা-অজানা নানা কারণে দেশের বাজারে ছাড়া হচ্ছে না। গুদামে পড়ে থেকে থেকে পচছে। নিজেদের চিনি গুদামে নষ্ট হচ্ছে আর মানুষ তিনগুণ দামে চিনি কিনছে, বিষয়টি সত্যিই বেদনাদায়ক বলে স্বীকার কালশীর বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোরের মালিক মনির হোসেন। আমরা খুচরা ব্যবসায়ীরা চিনি কিনতে গেলে আড়ৎদাররা বলেন, চিনি সংকট রয়েছে। কিন্তু বেশি টাকা দিলেই বস্তায় বস্তায় চিনি মেলে। এগুলো বড় ব্যবসায়ীদের কারসাজি।
রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টের কয়েকজন চা-দোকানির সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। মিরপুর পল্লবীর চা বিক্রেতা সাব্বির বলেন, চিনির দাম বাড়ার পরও এখনও চায়ের দাম এ এলাকায় বাড়ায়নি। রং চা ৫টা এবং দুধ চা ১০ টাকায় আছে। তবে অন্য জায়গায় বাড়িয়েছে বলে শুনেছি। এর ফলে দাম না বাড়ানোয় লাভতো হচ্ছে না। আমি যে শ্রম দিচ্ছি সেটাই লস। কারণ চা-য়ের থেকে কোনো বেনিফিট পারছি না। আর কাস্টমার তো কমবই। কারণ আয়ের উপরে সব কিছু।
আরেকটি চায়ের দোকানির কাছে চিনির দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বলে কোন লাভ হবে না। আমার যা বিপর্যয় তা হবেই। কালশীর চা-বিক্রেতা বশির বলেন, গ্যাস ও চিনির দাম বাড়ায় আমাদের অনেক সমস্যা হচ্ছে। আমাদের কাস্টমার কমে গেছে। আগে ৬টাকায় চা বিক্রি করলেও দুই টাকা বাড়িয়ে ৮টা করেছি। এর পর ব্যবসায় ধস নেমেছে। দৈনিক ৪০০ কাপ চা বিক্রি করলেও তা বর্তমানে অর্ধেকে নেমেছে। এই ক্ষতি পুষানোর সুযোগ নেই। এভাবে চললে ব্যবসায় বন্ধ করে দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, ৬০ টাকার চিনি একবছরে ১১৫ টাকায় কিনছি। এখানে বড় ঘাটতি। যার প্রভাব পড়েছে সংসার খরচেও। পণ্যের অযাচিত মূল্য বৃদ্ধির কারণে বড় অভাবে আছি। সরকার কি করবে তা আমাদের জানা নেই। রিফাত নামে চা-বিক্রেতা বলেন, আগে চা ৫টাকায় বিক্রি করলেও চিনির কারণে ৬টা করেছি। তাও লাল চা।
ওই বিক্রেতা বলেন, ক্রেতা বলছে; আগে ৫টাকায় এককাপ চা বিক্রি করলেও তাতে তোমাদের লাভ হয়েছে। অনেক ক্রেতা চা না খেয়ে চলে যাচ্ছে। এই বিক্রেতা আরও বলেন, অনেক ক্রেতা এসে আবদার দেখিয়ে বলে চা এর পরিমাণ কমিয়ে ৫টাকা সমপরিমাণ দেও। এতে আমার লস। না দিলে খারাপ কথা বলে ভেগে যায়। কি আর করব। চা-য়ের দাম বাড়ানোয় আমরা মহা বিপদে আছি। নুরুল ইসলাম নামে এক চা-বিক্রেতা বলেন, ৫টাকার চা ৬টাকা করা হলেও অনেকে চা খেয়ে ৫টাকা দিয়েই হেঁটে চলে যায়। চা ব্যবসা শিল্পে বিপর্যয় নেমে এসেছে।
আগে দৈনিক ২০ কাপ চা খেলেও এখন কমিয়ে সারাদিনে ৫ কাপও খাকছেন না বলে জানান হাবিবুর রহমান নামে একজন ব্যক্তি। আর ইলেকট্রিকের কাজের সঙ্গে যুক্ত আলমগীর নামে একজন ব্যক্তি বলেন, চিনির সঙ্গে অনেক কিছুর সম্পর্ক। চায়ের দাম বাড়ায় মহা সমস্যায় আছি। কারণ কেউ এক টাকা বাড়িয়েছে কেউ বাড়িয়েছে ৭ টাকা। এটা নিয়ে ভেজাল হয়। বলেন, ১০টাকা দিয়ে একটি সিগারেট একটি চা খেতাম। এখন ১০ টাকার সঙ্গে দুই টাকা বাড়তি গুণতে হচ্ছে। এটাও বড় সমস্যা। এ কারণে অনেক সময় চা খাই না। একটি সিগারেট নিয়ে চলে যায়। ক্ষুদ্রু ব্যবসায়ী বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোরের মালিক মনির হোসেন বলেন, চিনির দাম বাড়াতে অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। ক্রেতারা অনেক সময় অভিযোগ করে বলেন আপনারা ইচ্ছা করেই দাম বাড়িয়ে নিচ্ছেন। আবার বেচাকেনাও কম। আগে চিনির দাম কম ছিল। বিক্রি বেশি হত। এখন কম হচ্ছে। কিছুদিন আগেও ৮০টাকা ছিল এখন ১০৭ টাকা পাইকারি কিনতে হচ্ছে। বিক্রি করছি ১১৫ টাকায়।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. খলিকুজ্জামান বলেন, অন্য দেশে রমজান এলেই দ্রব্যের দাম অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়। আর এখানে পুরো উল্টো। এখানে পণ্যের সরবরাহ থাকলেও দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। সরকারের নজরদারির অভাব রয়েছে। এটা বাড়াতে হবে। চিনির সঙ্গে চা-য়ের সম্পর্ক আছে এটা ঠিক। একজন দাম বাড়ালেই সকলেই বাড়িয়ে দেন। কোথাও কোনো সমন্বয় করা হয় না; এটাই বড় সমস্যা। মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠছে; এটাই বড় শঙ্কার কথা।
পাইকারি পর্যায়ে ভোগ্যপণ্য বিক্রেতাদের নেতা মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী গোলাম মাওলা এ প্রসঙ্গে বলেন, চিনির দাম বাড়ার প্রধান কারণ ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও আমদানী পণ্যের উপরে সরকারের অতিরিক্ত করারোপ। আগের তুলনায় ৩৫টাকা বেশি কর দিতে হচ্ছে। বলেন, আমরা চিনি উৎপাদন করি না। মিল মালিকরা যেভাবে চালাবেন, আমাদের সেভাবেই চলতে হবে। বলেন, আমাদের কোনো বিকল্প উৎস্য নেই। সরকার থেকে কোনো ভর্তুকি পাই না। আর ট্রান্সপোর্ট খরচ দিতে হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি। এসব ক্ষতি পুষিয়ে তারপর আমাদের লাভ করতে হয়। চিনির মূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্ব্যভোগী কারা তাদের খুজে বের করেন।
সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ বিভাগ) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, হোলসেল মার্কেট থেকে বেশি দামে চিনি কিনে বেশি দামে বিক্রি করার সুযোগ নেই। অভিযানের ভয়ে চিনি থাকা সত্ত্বেও অনেকে বিক্রি করছেন না, এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এই পরিচালক বলেন, বিষয়টি আসলে এমন নয়। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী সংকট পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে বেশি দামে চিনি বিক্রি করছেন। তাই রমজানের আগেই আমাদের অভিযান চলমান আছে; আরও জোরদার করা হবে।
পিডিএস/এমএইউ