মনির হোসেন, বেনাপোল থেকে

  ০৩ জুলাই, ২০২২

বেনাপোলে ১৫ মিনিটেই ট্রাক প্রবেশ, পণ্য খালাসে অপেক্ষা দিনের পর দিন 

বেনাপোল বন্দরে পণ্য খালাসের অপেক্ষায় ভারতীয় ট্রাক। ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

ভারত থেকে একটি পণ্যবাহী ট্রাক বেনাপোল বন্দরে প্রবেশে মাত্র ১৫ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু বেনাপোল বন্দরের অভ্যন্তরে জায়গা সংকটের কারণে পণ্য খালাস করতে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ভারতীয় ট্রাক চালকদের। আর এ কারণে বেনাপোল বন্দরের ট্রাক টার্মিনালে শত শত ভারতীয় ট্রাক পণ্য খালাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে গত কয়েকদিন ধরে। ফলে এ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ক্রমেই আমদানি বাণিজ্য কমে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ধ্বস নামতে শুরু করেছে। সংশ্লিস্ট সূত্রে জানা গেছে, বেনাপোলের বিপরীতে ভারতের পেট্রাপোল বন্দর থেকে সিএন্ডএফ এজেন্টরা প্রথমে যে সব পণ্য বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করবে সে সমস্ত পণ্যের কাগজপত্র নিয়ে বেনাপোল চেকপোস্ট কাস্টমস কার্গো শাখায় জমা দেন। সেখানে মেনিফেস্ট নম্বর (আইজিএম) দিয়ে অনলাইনে বিস্তারিত এন্ট্রি হয়ে ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। ভারতের পেট্রাপোল পার্কিং থেকে ট্রাকগুলো নিয়ে চালক ও হেলপার চলে আসে কার্গো শাখায়। সেখানে অনলাইনে ট্রাক নম্বর, চালক ও হেলপারের বিস্তারিত এন্ট্রি হয়ে পণ্য প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। পরে একইভাবে বন্দর কর্তৃপক্ষও সেগুলো এন্ট্রি করে রাখে। এরপর যে সমস্ত পণ্যবাহী ট্রাকের স্ক্যানিং ও ওজনের নির্দেশ থাকে সেগুলো করার পর বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের নির্দিষ্ট শেডে (গুদাম) পোস্টিং দিলে সেখানে পণ্য আনলোড করা হয়। তবে শেডে জায়গা না থাকলে ট্রাক টার্মিনালে সেসব ট্রাকগুলো রাখা হয়।

করোনার পর থেকে প্রতিদিন বেনাপোল বন্দরে ৩০০ থেকে ৩৫০ ট্রাক পণ্যবাহী ট্রাক আসছে ভারত থেকে। কিন্তু বন্দর থেকে পর্যাপ্ত পণ্য খালাস না হওয়ায় বন্দরে এসব পণ্য রাখা যাচ্ছে না। এসব ট্রাক রাখা হচ্ছে বন্দরের ট্রাক টার্মিনালসহ বন্দরের আশে পাশে এলাকায়। ফলে পণ্য ও ট্রাকজট লেগে আছে বন্দরে। এ কারণে ভারত থেকে পণ্যবাহী ট্রাকগুলি পেট্রাপোল বন্দরে প্রবেশের আগে এক মাসেরও বেশি সময় আটকে রাখা হয় বনগাঁর পরিবহন দপ্তরের নিয়ন্ত্রনকারী কালিতলা পার্কিংয়ে। এর ফলে এক একটি পণ্যবাহী ট্রাক বেনাপোল বন্দরে প্রবেশে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে।

দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল। প্রতি বছর দেশের সিংহভাগ শিল্প কলকারখানা ও গার্মেন্টস ইন্ডাষ্ট্রির মালামালের পাশাপাশি কেমিকেল, মটর পার্টস, গাড়ির চেসিসসহ বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি হয়ে থাকে এ বন্দর দিয়ে। বছরে এ বন্দর দিয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকার মালামাল আমদানি ও ৮ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি হয়ে থাকে। সরকারের কোষাগারে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে। বেনাপোল বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায় জায়গা সংকটে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র পণ্যজট। এতে একদিকে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে তেমনি লোকসান গুনছেন ব্যবসায়ীরা। বন্দরে দীর্ঘদিনের এ সমস্যার কোনো সমাধান না হওয়ায় ক্ষোভ বাণিজ্য সংশ্লিষ্টদের। বন্দরের দুর্বল অবকাঠামোর কারণে ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যে আগ্রহ কমার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় দিন দিন কমে আসছে বলে জানালেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বেনাপোল বন্দরের জন্য ১৫০০ কোটি টাকার ১৭৫ একর জমি (নতুন শেড, কন্টিনার টার্মিনাল, হেভি স্টক ইয়ার্ড নির্মাণে জন্য) অধিগ্রহণের বিষয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পটি ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে। পরবর্তীতে উক্ত প্রস্তাবনাটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে সবুজ পাতাভূক্ত হয়েছে। কিন্তু অদ্যবধি প্রকল্পটির কোন অগ্রগতি হয়নি। বেনাপোল বন্দরে দ্রুত ভিত্তিতে ১৭৫ একর জায়গা অধিগ্রহন করা হলে এ বন্দর হতে কাস্টমস এর প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি টাকা এবং বন্দরের ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব।

বেনাপোল বন্দরের ব্যবসায়ীরা জানান, এই স্থলবন্দরের ৩৪টি গুদাম ও ৮টি ইয়ার্ড, ২টি ট্রাক টার্মিনাল ও একটি রপ্তানি টার্মিনাল রয়েছে। কোথাও কোন জায়গা খালি নেই। তীব্র পণ্যজট চলছে। বর্তমানে বেনাপোল বন্দরের গুদামের ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি পণ্য আমদানি হচ্ছে। বেনাপোল স্থলবন্দরে যে শেডগুলি আছে সেখানে মালামাল রাখার ধারণ ক্ষমতা বাস্তবে ৫৯ হাজার মেট্রিক টন কিন্তু বর্তমানে দুই লাখ মেট্রিক টন মালামাল হ্যান্ডলিং হয়। যে কারণে, ভারত হতে যে ট্রাকগুলি আসে তা বন্দরে ৮/১০ দিন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। বেনাপোল স্থল বন্দরে ১৭৫ একর জমি অধিগ্রহণপূর্বক সেখানে কমপক্ষে ৩০টি নতুন শেড, হেভি স্টক ইয়ার্ড, কোল্ড স্টোর নির্মাণ জরুরী। তাই এখনই বন্দর সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

বেনাপোল কাস্টম সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলহাজ শামছুর রহমান জানান, দেশের ৭৫ ভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাঁচামালের পাশাপাশি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য আসে এই বন্দর দিয়ে। আমদানিতে জটিলতার কারণে এসব পচনশীল পণ্য নষ্ট হচ্ছে এবং অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। রাজস্ব আদায়ও কমে যাচ্ছে। পণ্য আমদানিতে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনেক আমদানিকারক এ বন্দর ছেড়ে চলে গেছে অন্যত্র। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় দেশের স্থল ও রেলপথে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি হয় ভারত থেকে। গত দুই বছর করোনা মহামারির ধকলের পর এ বছর আমদানি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু বন্দরের গুদামে জায়গা সংকটের কারণে চাহিদামতো ট্রাক ঢুকতে না পারায় ব্যাহত হচ্ছে কার্যক্রম। এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট গেট হতে বন্দরের গোডাউন পর্যন্ত জ্যাম হয়ে থাকছে প্রতিনিয়ত। এর ফলে ভারতীয় ট্রাক প্রবেশ করছে ঢিলে ঢালা ভাবে। বেনাপোল স্থলবন্দরের জায়গা সংকটসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাস্তবায়ন করার জন্য একাধিকবার নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয়সহ বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেও কোন আশানুরুপ সাড়া পাওয়া যায়নি।

বেনাপোল স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক আব্দুল জলিল বলেন, অন্য সময়ের তুলনায় পণ্য আমদানি-রপ্তানি কয়েকগুণ বেড়েছে। স্থলবন্দরে পণ্যের ধারণক্ষমতা ৫৯ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু সেখানে দ্বিগুণের বেশি পণ্য রাখা হচ্ছে। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে আবার গতি ফেরায়, আমদানি-রপ্তানিও বেড়েছে। রেল পথেও প্রচুর পণ্য আসছে। এ কারণে পণ্য রাখার স্থান সংকুলান করা যাচ্ছে না। তারপরও বন্দর থেকে তেমন পণ্য বের হচ্ছে না। বন্দরে শেড-ইয়ার্ড সংখ্যাও বাড়াতে হবে। এরইমধ্যে জায়গা অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জায়গা অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে রয়েছে। অধিগ্রহণকৃত জায়গায় শীঘ্রই ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ শুরু হবে। ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ শুরু হলে বন্দরের পণ্যজটের সংকট অনেকটা কেটে যাবে বলে জানান তিনি।

বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, ভারতীয় একটি ট্রাক মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রবেশ করছে বেনাপোল বন্দরে। তারপর পোস্টিং দেওয়া হচ্ছে বন্দরের বিভিন্ন শেডে। কিন্তু শেডে জায়গার অভাবে ভারতীয় ট্রাক থেকে পণ্য আনলোড করা যাচ্ছে না। ফলে দিনের পর দিন ট্রাকগুলোকে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ট্রাক টার্মিনালে। প্রতিবছর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু সে অনুপাতে রাজস্বের উৎস বাড়ছে না। এতে প্রতিবছরই দেখা দিচ্ছে রাজস্ব ঘাটতি। বন্দরের জায়গা বৃদ্ধির জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বেনাপোল,বন্দর,পণ্য খালাস,দিন পার
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close