reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৮ জুন, ২০২২

বিদেশে পাচার হওয়া টাকা কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে?

প্রতীকী ছবি

আগামী অর্থবছরের জন্য যে বাজেট অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেছেন, তার একটি অংশ নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে। সেটি হলো, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ, কর দিয়ে ফিরিয়ে আনলে বৈধতা দেওয়া হবে।

গত এক দশকে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত দুটি শব্দ হলো- কানাডার বেগমপাড়া। যদিও এ নামে কোনও এলাকা নেই। তারপরেও বাংলাদেশ থেকে ভিন্ন পথে টাকা নিয়ে যেসব এলাকায় কিছু বাংলাদেশি ঘরবাড়ি কিনেছেন সেগুলোরই পরিচিত গড়ে উঠেছে বেগমপাড়া হিসেবে।

কানাডায় বাংলাদেশিদের বেগমপাড়ার সন্ধানে অনেক বছর ধরেই কানাডায় সপরিবারে বসবাস করেন কিশোয়ার লায়লা। তিনি বলছিলেন, বিষয়টি বাংলাদেশি হিসেবে প্রতিনিয়তই তাদের জন্য বিব্রতকর।

তার ভাষায়, আমি অনেক দিন ধরেই কানাডায় বাস করছি। অনেক কষ্ট করি। কিন্তু এখানে দেখি অনেক বাংলাদেশিই হুট করে এসে দামী বাড়ি গাড়ি কিনছেন। তারা যেসব এলাকায় থাকছেন সেটিই কমিউনিটির মধ্যে বেগমপাড়া হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। কারণ অনেকেই বিশ্বাস করেন, দেশ থেকে পাচার হয়ে আসা টাকাই এসব দামী বাড়ি গাড়ির পেছনে বিনিয়োগ করা হচ্ছে।

শুধু কানাডাই নয়। বরং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জসহ নানা দেশে বাংলাদেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে এমন অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল। যার প্রেক্ষাপটে দেশে পাচার প্রতিরোধে আইনি কাঠামোও জোরদার করা হয়।

অথচ এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী এমন একটি প্রস্তাব করেছেন, যাকে অনেকে মনে করছেন যে পাচার হওয়া অর্থ দায়মুক্তি দিয়ে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আয়কর অধ্যাদেশে নতুন একটি বিধান সংযোজনার প্রস্তাব করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে, ‘বিদেশে অবস্থিত যেকোনও সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ যেকোনও কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনও প্রশ্ন উত্থাপন করবে না।’

এ জন্য তিনি অর্থ, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের ওপর আলাদা কর হার ধার্য করে দিয়েছেন। এই কর দিলেই বাংলাদেশিরা এসব অর্থ সম্পদ বৈধভাবে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে পারেন। বাজেট বক্তব্যে এ প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেছেন, তিনি মনে করেন, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে এ বিধান সহায়তা করবে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলছেন, এ ধরণের বিধান করার আগে অর্থ মন্ত্রণালয় মানি লন্ডারিং নিয়ে যারা কাজ করছে, তাদের সাথে কোনও আলোচনাই করেনি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে স্টেক হোল্ডারদের সাথে আলোচনা হয়েছে বলে মনে হয় না। ইন্টারেকশন হলো, বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা হতো । এ ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হতো।

তিনি বলেন, সরকারের উচিত ছিল, ভারতে যে কালো টাকা সাদা করা বা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আইনের কী ধরণের ইফেক্ট বা আউটকাম হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখা । আসলে পাচার হওয়া টাকা নিয়ে এত কথা হয়েছে যে, আমার মনে হয়েছে, সরকার পর্যুদস্ত হয়ে গেছে পাচার হওয়া টাকার বিষয়ে। এ কারণেই টেস্ট কেস হিসেবে হয়তো সরকার এ সুযোগ দিয়েছে।

বাংলাদেশের আইনে অর্থ পাচার দণ্ডনীয় অপরাধ। দুর্নীতি দমন কমিশনের হয়ে অর্থ পাচার মামলাগুলোর দায়িত্বে থাকা খুরশিদ আলম খান বলছেন, ভারত কয়েক বছর আগে এ ধরণের উদ্যোগ নিয়ে ভালো ফল পায়নি।

তবে বাজেটে যাই অনুমোদন হোক না কেন, সেটি পাচার হওয়া অর্থের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করতে দুদকের জন্য কোনও বাধা থাকবে না বলে দাবি করেন তিনি।

দুর্নীতি দমন আইন ও মানি লন্ডারিং আইনগুলো বিশেষ আইন। এখন সংসদে অর্থ আইনে যাই বলা হোক ক্রিমিনাল অফেন্সের জন্য কোনও সমস্যা হবে না। ট্যাক্স দিয়ে টাকা হয়তো হালাল করতে পারবেন। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনে সুযোগ আছে অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করতে ও আইনগত প্রক্রিয়া নেওয়ার জন্য। এজন্য দুদকের অর্থ পাচার মামলার ক্ষেত্রে এর কোনও প্রভাব পড়বে না।

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনায় দুর্বলতা কোথায়? তাহলে দুদক বা অন্য কোনও সংস্থার যদি আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকেই তাহলে যিনি অর্থ পাচার করেছেন তিনি কেন সেই ঝুঁকি নিয়ে দেশে সেই সম্পদ বা অর্থের কর দিতে আসবেন, এগুলো বৈধ করে নেয়ার জন্য- এ প্রশ্ন উঠছে।

তবে এ যুক্তি নাকচ করে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, নতুন প্রস্তাব কার্যকর হলে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আসবে।

মন্ত্রীর বক্তব্য, বিভিন্ন কারণে টাকা চলে যায়। আমরা আইডিয়া করছি যে, টাকা পাচার হয়ে গেছে। আমরা ফেরত আনার চেষ্টা করছি। এগুলোতে বাধা দিয়েন না। না এলে লাভ কী হবে। ১৭টি দেশ দায়মুক্তি দিয়ে টাকা ফেরত এনেছে। আসবে এবং এটাও একটা চেষ্টা করতে হবে।

অর্থ ফিরবে নাকি পাচার বাড়বে গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এক্ষেত্রে একটি অগ্রগতি হয়েছে। তা হলো সরকার এই প্রথমবার স্বীকার করে নিলো যে, দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। এর আগে ২০২১ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে প্রকাশ করেছিলেন বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন আছে - তার কিছুটা সত্যতা তিনি পেয়েছেন। এ ধরনের ২৮টি ঘটনার তথ্যও তাদের কাছে আছে, এমনটি বলার পর তার বক্তব্য নিয়ে শোরগোল উঠেছিল। কিন্তু পাচার হওয়া সে অর্থ ফিরিয়ে আনতে সরকার কোনও উদ্যোগ নিতে পারেনি। অথচ এখন অর্থমন্ত্রী নিজেই কর দিয়ে পাচার করা অর্থ ও সম্পদ ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব করেছেন।

পাচারকারীদের দায়মুক্তির এ সুযোগ অর্থ পাচার প্রতিরোধে কতটা কাজ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

তিনি বলেন, দেশ থেকে প্রেরিত অর্থের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি নানা পর্যায়ের লোকজনের যুক্ত হবার প্রবণতা তৈরি হয়। এ ধরনের সুযোগ নিয়ে তাদেরও দায়মুক্তির সুযোগ তৈরি হয়। কতটা অর্থ ফিরে আসবে, তা দেখার আগে দেখতে হবে যে এ ধরনের দায়মুক্তির মাধ্যমে আইনি ও নৈতিক ভিত্তিগুলো আমরা কতটা দুর্বল করে দিচ্ছি।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) ২০২০ সালে বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। তারা বলেছিল, ২০০৮ সালের পরে বাংলাদেশে পণ্যের মূল্য ঘোষণায় গরমিল দেখিয়ে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৫১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিদেশে চলে গেছে।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, এখন কর দিয়ে বৈধ করার মতো সুযোগ দিলে পাচার হওয়া অর্থ ফিরে আসবে, এটি একেবারেই অযৌক্তিক ও অন্যায় একটি চিন্তা। বরং এর মাধ্যমে অপরাধের যে দায়মুক্তি দেয়া হলো, তা পাচার প্রবণতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

তার মতে, এ ধরনের প্রণোদনামূলক ব্যবস্থার টাকা ফেরত আনার চেয়ে টাকা বাইরে যাবার প্রবণতাকে উৎসাহিত করবে। একই সঙ্গে আমরা জানি যে, দেশ থেকে টাকা পাচার হওয়া ঠেকাতে খুব কার্যকর ব্যবস্থা এখনো তৈরি হয়নি। সেটি না থাকায় এ ধরনের প্রণোদনা কেবল টাকা পাচারকেই উৎসাহিত করবে। সূত্র : বিবিসি

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অর্থ পাচার,বেগমপাড়া,কানাডা,মালয়েশিয়া,যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close