গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৮ মে, ২০২২

চিংড়িশিল্পে ধস

বছরের অর্ধেক সময় ছুঁই ছুঁই। এখনো অনেক ঘের মালিক এক কানাকড়ির চিংড়ি মাছও বিক্রি করতে পারেনি। কারণ যা বিনিয়োগ তার পুরোটাই পানিতে শেষ হয়েছে। পোনা ছাড়ার পর বিক্রির উপযোগী হওয়ার আগেই অজ্ঞাত ভাইরাসে চিংড়ি মারা যাওয়ায় এ বেহাল অবস্থা।

বাকি মাসগুলোতে পেছনের ঘাটতি পূরণ করে লাভের মুখ দেখবে চিংড়ি ঘের মালিকরা—এমন আশাও ক্ষীণ। ফলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। ঋণের জালে আটকে পড়ছে অনেকেই। বলা যায়, ধস নেমেছে সাদা সোনা খ্যাত এই বাগদা চিংড়ি শিল্পে।

এদিকে, অজানা ভাইরাস সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে চিংড়ি শিল্পের সঙ্গে জড়িত ঘের মালিকদের। কেন এবং কি কারণে মাছ মরছে নেই এর সঠিক ব্যাখ্যা। তবে এ নিয়ে চিংড়ি শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে নানা মত। যার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই।

অথচ টনক নড়ছে না সরকারের। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চিংড়ি মরার কারণ খুঁজতেও নেওয়া হয় না কোনো উদ্যোগ। ফলে দেশের রাজস্ব খাতে বড় অবদান রাখা এই খাতের মানুষ নিরুপায় হয়ে বদলে ফেলছে পেশা। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার অনেক এলাকায় স্বপ্রণোদিত হয়ে গত বছর বন্ধ হয়েছে চিংড়ি চাষ। বাপ-দাদার পুরোনো পেশা ধান চাষে ফিরলেও জমিতে অতি-লবণাক্ততায় ভালো ফল পাননি অনেক কৃষক। ধান চাষে লোকসান এবং চিংড়ি চাষে পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত মানুষ। ফলে উভয় সংকটে উপকূলের একমাত্র উপার্জনের পথ চিংড়ি উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানা প্রতিকূলতার মধ্যে উপকূলের মানুষের মুখে হাসি এনে দিয়েছিল বাগদা চিংড়ি চাষ। স্বল্প পুঁজিতে অধিক মুনাফায় অল্পদিনেই স্বাবলম্বী হয়েছিল সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় এলাকার এক-শ্রেণির মানুষ। সময়ের পরিক্রমায় মড়ক শুরুর পর ‘সাদা সোনা’ খ্যাত বাগদা চিংড়ি এখন হতাশার কারণ। কেননা ভরা মৌসুমেও সাতক্ষীরার চাষিদের মুখে হাসি নেই। বাগদা চিংড়ি উৎপাদনে ধস নামায় লোকসানের মুখে এ শিল্পের লোকেরা।

মৎস্য বিভাগ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন, অনাবৃষ্টি, ঘেরে পানিস্বল্পতা, অতিরিক্ত পোনা মজুদ, তাপমাত্রা ও পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় চিংড়ি মরে যেতে পারে। এসব নানা কারণকেই চাষিরা ভাইরাস সংক্রমণ হচ্ছে বলে ধারণা করছেন। আবার অনেকে মনে করছেন, চিংড়ির ব্যাপক মড়কের জন্য পানি ও খাদ্যই দায়ী। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ উপজেলায় চিংড়ি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হবে। এ উপজেলায় আশির দশক থেকে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় লোনাপানির চিংড়ি চাষ। সনাতন পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের ফলে মাটির উর্বরাশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণেও চিংড়ি মরে যেতে পারে।

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের পরাণপুর, মেন্দীনগর, নৈকাটি ও মির্জাপুর এই চারটি এলাকায় সাড়ে ৫ হাজার এলাকাজুড়ে বছর বছর চিংড়ি চাষ হয়ে আসছে। এর মধ্যে মেন্দীনগর মৌজায় ২ হাজার বিঘা, পরাণপুরে দেড় হাজার বিঘা, মির্জাপুর ও নৈকাটিতে এক হাজার করে বিঘা রয়েছে। পুরো উপজেলাজুড়ে লক্ষাধিক বিঘায় চিংড়ি চাষ হচ্ছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২৩ বছর সরকারের বাইরে থাকার পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারে আসে। বর্তমান এ সরকারের সময়ে ব্যাপকভাবে চিংড়ি চাষ শুরু হয়।

শুধু সাতক্ষীরা নয়, খুলনা জেলার বৃহৎ একটি অংশজুড়েও চাষ হয় বাড়দা চিংড়ি। খুলনা জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, খুলনা জেলায় বাগদা ঘের রয়েছে ২৩ হাজার ৪৪০টি। দাকোপে ২ হাজার ৫১৬টি, পাইকগাছায় ৩ হাজার ৯৪০টি, কয়রা ৭ হাজার ২০০টি, বটিয়াঘাটায় ৮১১টি, ডুমুরিয়ায় ৭ হাজার ৮২১টি, রূপসায় ১ হাজার ১৫১টি ও তেরখাদায় ১টি ঘের রয়েছে।

শ্যামনগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তুষার মজুমদার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, শ্যামনগর উপজেলায় মোট ১৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে মৎস্য চাষ হচ্ছে। আর চিংড়ি চাষির সংখ্যা সাড়ে ১৬ হাজারের উপরে। ভাইরাসের কারণে চিংড়ি মারা যাচ্ছে এটা সঠিক নয়। কারণ এ বছর তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণে অপরিণত বয়সে মাছ মারা যাচ্ছে। তবে কৃষি প্রণোদনায় আর্থিক সহায়তা থাকে না। তবে ঘেরে কোনো বিপর্যয় দেখা দিলে সেখানে গিয়ে মৎস্য উপযোগী চাষের জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকি। আর পৃষ্টপোষকতা বলতে এটাই। কারণ বৃষ্টি হলে কি করতে হবে এবং বৃষ্টির পরে কি পদক্ষেপ নিতে হবে—সে পরামর্শ দিয়ে থাকি। মাছগুলো যাতে না মারা যায় সে বিষয়েও পরামর্শ দিয়ে থাকি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আকতার হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘এ বছর বাগদা চিংড়ি ধরার উপযোগী হওয়ার আগেই মারা যাচ্ছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ ঘের মালিক কিংবা মৎস্য কর্মকর্তার কাছ থেকে পায়নি। কিন্তু চিংড়ি এই অঞ্চলের একটি প্রধান আয়ের উৎস এবং এটাকে ঘিরে বেশকিছু শিল্পও গড়ে উঠেছে। তিনি বলেন, চিংড়ি মরার কারণগুলো খতিয়ে দেখার জন্য মৎস্য কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করব। প্রয়োজনে স্যাম্পল এনে ভালো গবেষণাগার থেকে পরীক্ষা করিয়ে মরার কারণ অনুসন্ধান করব। যদি পরীক্ষায় ভাইরাসজনিত কারণে চিংড়ি মারা যায় তাহলে ভর্তুকির কি ব্যবস্থা রয়েছে মৎস্য কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে ব্যবস্থা করা হবে।’

এদিকে চাষি ও ঘের মালিকরা বলছেন, চিংড়ি শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের আন্তরিকতা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। শ্যামনগরের কেখালী ইউপির মেন্দীনগর গ্রামের শরীফ বলেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করছি। জমির পরিমাণ একবিঘা। প্রতি বিঘায় খরচ হয় ক্ষেত্র বিশেষে প্রায় ১ লাখ টাকা। প্রতি চার মাস পর পর চিংড়ি বিক্রি না করলে খরচ পোষায় না। অথচ যারা অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ করছে তাদের অবস্থাও শোচনীয়। কারণ লোকাল হ্যাচারিগুলো না বুঝেই রেণু পোনা নার্সিং করছে। পরে ঘেরে সেটা আসার পর তার সক্ষমতা শেষ হওয়ার পর ভাইরাসে মারা যাচ্ছে। লোকাল হ্যাচারিং মাছ হাজারে ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা। সেখানে কক্সবাজারের হ্যাচারিগুলোতে হাজারে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গভীর সমুদ্র থেকে ধরে আনা মা বাগদাগুলোর শরীরে কোনো ভাইরাস আছে কি না তা পরীক্ষা না করে যত্রতত্র রেণু পোনা উৎপাদনের কারণে সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

মির্জাপুর গ্রামের এক চিংড়ি মালিক বলেন, আমার কয়েক বিঘা বাগদা চিংড়ির ঘের আছে। এবার বাগদার দাম বেশি কিন্তু উৎপাদন খারাপ। চিংড়ি বড় হয়নি। অতিরিক্ত বৃষ্টি ও মাছের মান খারাপ হওয়ায় উৎপাদন কম হয়েছে। আগে ভাইরাস না লাগলেও বর্তমানে সামান্য লেগেছে। এতে কিছু মাছ মরে যাচ্ছে। ছোট মাছের দাম কম হলেও বড় চিংড়ি বর্তমানে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

পরাণপুর বিলের বাগদা চাষি মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ঘেরে এবার বাগদা চিংড়ির উৎপাদন খুব খারাপ। চিংড়ি চাষ খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। দেখা যায় আগের বছর যার ভালো হয়েছে। এবার তার ভালো হয়নি। মাছের পোনা যখন ছাড়া হয় তখন বৃষ্টি কম হওয়ায় পানি অতিরিক্ত লবণাক্ত হয়ে যাওয়ায় মাছ চাষ ভালো হয়নি।

চিংড়ি ব্যবসায়ী মো. গোলাম হোসেন বলেন, এ বছর ব্যবসা ভালো যাবে না। এখন পর্যন্ত চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন খুবই কম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার বাগদার ভরা মৌসুম চললেও মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কম। মাছের আড়তগুলোতে গতবারের তুলনায় মাছ উঠছে অর্ধেক। যদিও দাম গত দুই বছরের তুলনায় কেজিপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেশি।

ঘের বদলে ধান চাষ করলেও লবণাক্ততার কারণে ফলন ভালো হয়নি বলে মন্তব্য করেন কৈখালির মল্লিকপাড়া গ্রামের পল্লী চিকিৎসক আশরাফুল ইসলাম। বলেন, চিংড়িতে ভালো যাচ্ছিল না। গত কয়েক বছর লোকসানের পর চিংড়ি বাদ দিয়ে ধান চাষ করি। তবে সেখানেও ফসল ভালো হয়নি।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চিংড়িশিল্প,ভাইরাস,সাতক্ষীরা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close