গাজী শাহনেওয়াজ

  ৩০ এপ্রিল, ২০২১

উভয় সংকটে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক

নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি ও কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে দুই ধরনের সংকটে পড়েছেন আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকরা। একদিকে ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় চাপের মুখে পড়েছেন অনেকে। অপরদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয় করেও লভ্যাংশের টাকা পাচ্ছেন না সময়মতো। এ নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।

কোভিড সংক্রমণ পরিস্থিতিতে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ঋণগ্রহীতাদের কিস্তি দিতে বাধ্য করা যাবে না। পাশাপাশি এ সময়ে কিস্তি দিতে ব্যর্থ হলেও বাড়তি সুদ আরোপ করা যাবে না। এ-সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে অনেক আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান ওই নির্দেশনা মানছে না বলে গ্রাহকদের অভিযোগ।

ক্ষুদ্র ব্যবসায় বিনিয়োগ করার লক্ষ্যে নিজাম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি গুলিস্তানে ব্র্যাক ব্যাংকের আলুবাজার শাখা থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নেন। ১৯ মাস সময় নিয়ে গত এক বছরে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করেন। কোভিড দুর্যোগে ব্যবসায় মন্দা থাকায় এক মাসের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেননি। এ কারণে তাকে ব্যাংক থেকে নোটিস দিয়ে মামলা দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে নিজাম উদ্দিন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘গুলিস্তানে একটি দোকান নিয়ে গার্মেন্টসের কয়েকটি মেশিন বসিয়ে ব্যবসা করতাম। তবে কোভিডের প্রভাবে ব্যবসায় মন্দাভাব থাকায় গত ডিসেম্বরে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছি। দুই মাস আগে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে চাকরি নিয়েছি। এই সংকটের মধ্যে কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমাকে মামলা দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। তাদের বলেছি মামলা দেন, জেলে যেতে প্রস্তুত আছি। আর যদি সময় দেন, বেতন পেয়ে আপনাদের টাকা পরিশোধ করে দেব। তবু তারা চাপ দিয়ে যাচ্ছেন।’ শুধু নিজাম উদ্দিন নন, ব্র্যাক ব্যাংকের মিরপুর ১১ নং সেকশন শাখা থেকে ৯ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন মায়ের দোয়া জেনারেল স্টোরের মালিক নয়ন। আর কাকরাইলে একটি শাখা থেকে ঋণ নেন নাজমুল। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক করোনাকালীন ঋণগ্রহীতাদের কিস্তি ছাড়ে একটি পরিপত্র জারি করেছে। তবে এটি বেসরকারি ব্যাংকগুলো মানে বলে আমার মনে হয় না। কারণ আমাকে প্রতি মাসের ২৪ তারিখের আগে এসএমএস দিয়ে কিস্তি পরিশোধের তাগিদ দিচ্ছে; সে অনুযায়ী কিস্তি দিয়ে যাচ্ছি।’

ব্র্যাক ব্যাংক আলুবাজার শাখার রিলেশন অফিসার (আরও) মোহাম্মদ সায়েম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘কোভিডে আর যাই হোক ব্যাংক বন্ধ নেই। পরিবহন ছাড়া ব্যাবসা-বাণিজ্য এবং গ্রাহকের লেনদেন সবই চলছে। কিছু মানুষ করোনার দোহাই দিয়ে কিস্তি দিতে অপারগতা প্রকাশ করছেন। আমরা তাদের নিয়মের মধ্যে থেকে চাপ দিচ্ছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার বিষয়টি খেয়াল রেখে ব্যাবস্থা নিচ্ছি। কিস্তি পরিশোধের বিলম্বের কারণে অতিরিক্ত টাকা পরিশোধ করতে হবে এ ক্ষেত্রে আমাদের করার কিছুই নেই।’

তবে এ বিষয়ে এই ব্যাংক শাখার ম্যানেজার মাসুদ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এদিকে, মিরপুরের একটি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড থেকে এক লাখ টাকায় মাসিক ১ হাজার ৮০০ টাকা লভ্যাংশের শর্তে বিনিয়োগ করেন ইদ্রিস নামে এক দোকানি। তিনি বলেন, ‘গত বছর করোনা শুরুর পর থেকে মাসে গ্রাহকের লভ্যাংশের টাকা দিতে গড়িমসি শুরু করে এই প্রতিষ্ঠান। মহামারি সহনীয় পর্যায়ে এলে লভ্যাংশের বকেয়া সমন্বয় হয়েছিল। এ বছর আবার কোভিড সংক্রমণ শুরুর পর মার্চের লভ্যাংশের টাকা এপ্রিলের ২০ তারিখ থেকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়; তবে আজও বুঝিয়ে দেয়নি। অথচ মহামারির আগে লভ্যাংশের টাকা মাসের শুরু থেকে দেওয়া শুরু করত। এখন তা পারছে না। এভাবে চললে গ্রাহকের লভ্যাংশের টাকা এক মাস বকেয়া হয়ে যাবে। আগামী মাসেও গ্রাহকের মুনাফা দিতে পারবে কি না সংশয় রয়েছে।’

বাবুল ও ইউনূস দুজনই ঢাকায় ব্যাবসা করেন। তারা দৈনিক কিস্তির ভিত্তিতে দি ঢাকা মার্কেটাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড থেকে যথাক্রমে এক লাখ ও আড়াই লাখ টাকা ঋণ নেন। বাবুল এক লাখের বিপরীতে দৈনিক ৬০০ টাকা এবং ইউনূস আড়াই লাখের বিপরীতে দেড় হাজার টাকা কিস্তি দেন। করোনাকালীন দুর্যোগে ব্যাবসায় মন্দাভাব চললেও কিস্তিতে কোনো ছাড় পারছেন না বলে এ প্রতিবেদককে জানান তারা।

দি ঢাকা মার্কেটাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড সঞ্চয়ের বিপরীতে লভ্যাংশ এবং ঋণ দেয়। তারা এই মহামারিকালেও ঋণ ঠিকমতো বুঝে নিলেও মুনাফা দিতে গড়িমসি করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

গ্রাহকদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দি ঢাকা মার্কেটাইল কো-অপারেটিভ ব্যাক লিমিটেডের ইনভেস্টমেন্ট অফিসার (আইও) মইনুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীদের বাইরে কাউকে ঋণ দেওয়া হয় না। ঋণের শর্তে বলা আছে যেকোনো পরিস্থিতিতে কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। তাই কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ দৈনিক কিস্তির ক্ষেত্রে এক দিন পার হলেই দ্বিগুণ হয়ে যায় ঋণের কিস্তির টাকা। আবার তাদের কাছ থেকে কিস্তি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মাসিক লভ্যাংশ বুঝিয়ে দিতে হয়। তবে সব সময় মাসিক লভ্যাংশ সময়মতো বুঝিয়ে দেওয়া যায় না।’

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সংকটময় মুহূর্তে দুপক্ষের উচিত সহনশীল আচরণ করা এবং উভয়ের স্বার্থ সমুন্নত রেখে সমস্যা মোকাবিলা করা।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মীর্জা আজিজুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘ব্যাংক ও গ্রাহক একে-অপরের পরিপূরক। তাই সংকট মোকাবিলায় দুপক্ষকেই সহনশীল আচরণ করা উচিত। যারা ঋণ নিয়েছেন তাদের উচিত ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে তাদের সমস্যা তুলে ধরা। কিস্তির টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন, সে বিষয়ে আশ্বস্ত করা। যাতে ব্যাংক না ভাবে করোনার অজুহাতে কিস্তি পরিশোধ করতে গ্রাহক গড়িমসি করছেন। আবার গ্রাহকের অবস্থা বুঝে ব্যাংকের উচিত হবে কিস্তি পরিশোধে তাদের ছাড় দেওয়া।’

সঞ্চয়ের লভ্যাংশ পরিশোধ করতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়িমসি করছে, এ নিয়ে গ্রহকের মধ্যে অসন্তোষও সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘সচ্ছলভাবে সংসার চালাতে বাড়তি আয়ের আশায় ব্যাংক বা মাল্টিপারপাসে টাকা রাখেন গ্রাহকরা। তাই বিনিয়োগ করা টাকার লভ্যাংশ গ্রাহকের পাওয়াটা আইনগতভাবে বৈধ। করোনাকালীন যদি এটা দিতে যৌক্তিকভাবে বিলম্ব করে, তাহলে এক কথা। আর যদি গ্রাহককে হয়রানির উদ্দেশ্যে বিলম্ব হয়, তাহলে সেটা অন্যায়। তবে সবারই উচিত সহনশীল আচরণ এবং উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে চলা।’

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
গ্রাহক,সংকট,আর্থিক প্রতিষ্ঠান
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close