শাহজাহান সাজু

  ১৫ জানুয়ারি, ২০২১

অর্থের সংস্থান নিয়ে নির্ভার সরকার

নভেল করোনাভাইরাস মহামারির কারণে নানা শঙ্কা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছিল সরকার। তখন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বাজেট বাস্তবায়নে অর্থ সংস্থান নিয়ে। কারণ নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণাকালে দেশের অর্থনীতি প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছিল। মহামারির কারণে মার্চ থেকে টানা তিন মাস দেশের মানুষ ঘর থেকে বেরোতে পারেননি। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থের জোগান নিয়ে তেমন কোনো চাপে পড়তে হয়নি সরকারকে। এমনকি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকও সরকার খুব ভালোভাবেই পার করছে। সব মিলিয়ে মহামারির দুঃসময়েও অর্থের সংস্থান ও উৎস নিয়ে স্বস্তিতেই আছে সরকার।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে পরিচালনা করছে সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাজেট বাস্তবায়নে অর্থের সংকটে পড়েনি সরকার। তার অন্যতম কারণ সংকটকালেও প্রথম প্রান্তিকে বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ১১ শতাংশ। আবার মুদ্রাবাজারে অলস তারল্যের কারণে সরকারের সুদ ব্যয়ও অনেক কমেছে। সরকারের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও ফিরেছে রেকর্ড উদ্বৃত্তের ধারা। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের ওপর ভর করে বেড়েই চলেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। রিজার্ভ এরই মধ্যে ৪২ বিলিয়ন বা ৪২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আগেই ঠিক করেছিলাম ৩০ ডিসেম্বরের আগে রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাব, আমরা তার আগেই তা নিয়ে যেতে পেরেছি। এটিই জাতির জন্য পাওয়া। আমি মনে করি, আমাদের কমিটমেন্ট আছে ২০৩০ সাল নাগাদ আমরা ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভকে ৫০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাব। হিসাব করেই বলছি এবং প্রত্যাশা করি, সে লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করা যাবে।’

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, করোনার সংকটকালেও সামষ্টিক অর্থনীতি স্বস্তিতেই রয়েছে। এর বড় কারণ হচ্ছে, সরকারকে অর্থ সংস্থানের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি।

এনবিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আয় হয়েছে ৪৯ হাজার ৯৮৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা (সাময়িক), যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ১১ শতাংশ বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আয় হয়েছিল ৪৮ হাজার ১৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সরকারকে ব্যাংক খাত থেকে ২৭ হাজার ১১৫ কোটি টাকা ঋণ নিতে হয়েছিল। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। ব্যাংক খাত, সঞ্চয়পত্র ও বিদেশি উৎস মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রায় ৩১ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। যদিও আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই তিন উৎস থেকে সরকারকে ঋণ নিতে হয়েছিল ৩৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকার। আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে চলতি অর্থবছরে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ২০ হাজার কোটি টাকা। দেশের ব্যাংক খাতে সৃষ্টি হয়েছে রেকর্ড ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য। ব্যাংকগুলোতে পড়ে থাকা অলস তারল্যের সুবিধা পাচ্ছে সরকার। এতে সরকারের সুদ ব্যয় অনেক কমে এসেছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সরকারের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ৭১ কোটি ডলার ঘাটতি ছিল। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫৩ কোটি ডলার। একই সঙ্গে সরকারের ব্যালান্স অব পেমেন্টেও (বিওপি) রেকর্ড উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিওপিতে ২০ কোটি ডলার ঘাটতি থাকলেও চলতি বছরের একই সময়ে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০৯ কোটি ডলার। অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বিদেশি উৎস থেকে সরকার ঋণ পেয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের উল্লিখিত সময়ে বিদেশি উৎস থেকে ৮ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার।

২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এই বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে এনবিআর উৎস থেকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। এনবিআরবহির্ভূত উৎস থেকে কর-রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া করবহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আহরণ করা হবে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক উৎস থেকে ৮০ হাজার ১৭ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। আবার অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সংগৃহীত হবে ৮৪ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে আসবে ২৫ হাজার কোটি টাকা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সরকার,অর্থের সংস্থান,বাণিজ্য,প্রবৃদ্ধি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close