মো. হেলাল মিয়া

  ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

দৃষ্টিপাত

মানহীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা উচ্চশিক্ষায় মহামারি

সম্প্রতি, দেশে তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরের দাবিতে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা অযৌক্তিক আন্দোলন করে আসছে। সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে অযৌক্তিক দাবি নিয়ে রাস্তা দখল করে নগরবাসীর দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। ঢাকার মতো যানজটপূর্ণ শহরে বেশকিছু সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরে অনেক সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। শুধু ঢাকাতেই রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি), বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি), আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি। বর্তমানে দেশে মোট ৫৫টি সরকারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যার মধ্যে গত ১৫ বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২৬টি সরকারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলোর মধ্যে আবার ভবন ভাড়া করে বা অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চলমান রেখেছে ২১টি সরকারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এর বাহিরেও মোট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১১৫টি। যার মধ্যে গত ১৫ বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৬১টি। এগুলোর মধ্যে আবার ক্যাম্পাসবিহীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৭৮টি। এছাড়াও প্রস্তাবিত নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১০টি।

বিগত ১৫ বছরে দেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মহামারি আকার ধারণ করেছিল। কোনো ধরনরে গুণাগুণ বিবেচনা না করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছিল বিগত সরকার। এছাড়াও বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এখনো পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হয়েও উঠেনি। রয়েছে অনেক কম অনুষদ এবং ডিসিপ্লিন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই উন্নত গবেষণাগার ও গবেষণার সরঞ্জাম।

এছাড়াও যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকের আদর্শ অনুপাত সাধারণত ১৫:১ থেকে ২০:১ এর মধ্যে হওয়া ভালো বলে বিবেচিত হয় সেখানে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত বিবেচনায় পর্যাপ্ত পরিমাণে শিক্ষক নেই এমন বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১৮টি এবং ৩০ শতাংশেরও কমসংখ্যক শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা রয়েছে এমন বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ২১টি। তাছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী বিবেচনায় পর্যাপ্ত পরিমাণে শিক্ষক নেই এমন বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৪৫টি। পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক না থাকায় পাঠদান ও গবেষণার কাজও হচ্ছে না ঠিকঠাক। এ জন্য দিনদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের মান তলানিতে চলে যাচ্ছে।

পৃথিবীর আর কোনো দেশে আয়তন, ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যা বিবেচনায় এতো বেশি সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না করিয়ে গুনগত মানসম্পন্ন শিক্ষার্থী ভর্তি করে উন্নত প্রযুক্তি ও গবেষণাগার নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এগিয়ে নিতে হবে এবং নামে বেনামে সরকারি ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুনগত মান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শুধু ঢাকাতেই যেখানে বেশকিছু প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেখানে আবারও একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রুপান্তর করা অযৌক্তিক। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ক্যাম্পাস, আবাসন সুবিধা, গবেষণাগার প্রয়োজন এমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোর কাঠামো আলাদা হয়ে থাকে। সেখানে একটি কলেজের কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় রুপান্তর করলে শিক্ষা ও গবেষণার অসুবিধার পাশাপাশি পর্যাপ্ত জ্ঞানচর্চা বাধাগ্রস্ত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিতুমীর কলেজ ব্যতীত আরো ছয়টি খ্যাতিসম্পন্ন কলেজ রয়েছে। সেগুলো তিতুমীর কলেজের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর করলে বাকি ছয়টি কলেজকেও বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর করতে আন্দোলন করলে সরকার কি সেগুলোকেও বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর করবে?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাত্র একটি আসনের বিপরীতে অনেক সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি পরিক্ষা দিয়ে থাকেন। সেখানে এমসিকিউ এর পাশাপাশি লিখিত পরিক্ষা নেওয়া হয় কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর সাত কলেজের ভর্তি পরিক্ষায় একটি আসনের বিপরীতে হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন শিক্ষার্থী ভর্তি পরিক্ষা দিয়ে থাকেন। সেখানে শুধু এমসিকিউ পদ্ধতিতে ভর্তি পরিক্ষা নেওয়া হলেও কোনো ধননের নেগেটিভ মার্কিং করা হয় না। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে সাত কলেজে কম পড়াশোনা করে খুব সহজেই চান্স পাওয়া যায়। এছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে কারমাইকেল কলেজ, রাজশাহী কলেজ, এডওয়ার্ড কলেজ, ব্রজমোহন কলেজ, আনন্দমোহন কলেজ, আজিজুল হক কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজসহ বেশকিছু খ্যাতিসম্পন্ন কলেজ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আবার কতগুলো শতবর্ষী কলেজও রয়েছে। যদি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর করা হয় তাহলে সেই কলেজগুলোকেও বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর করার জন্য আন্দোলন, অবরোধের মুখে পড়তে পারে সরকার। আয়তন, অবস্থান এবং শিক্ষার্থী বিবেচনায় তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরের যোগ্যতা রাখে।

বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে তা পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশেও নেই। দিনদিন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং উল্লেখযোগ্য হারে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে অহরহ মানহীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করে প্রয়োজনে একটি নির্দিষ্ট মান নির্ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমিয়ে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগতমান নিশ্চিত করতে পারলে উচ্চশিক্ষায় সুফল বয়ে আসবে। যারা সেই নির্ধারিত মান অতিক্রম করতে পারবে না তাদেরকে বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা নয়। নয়তো এটা করা যেতে পারে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাজেট দিয়ে অবকাঠামো তৈরি করে দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে সেগুলোর গুনগতমান নিশ্চিত করে, তারপর প্রয়োজন হলে নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। কিন্তু বর্তমানে নতুন করে আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা নেই।

অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি না করে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে এগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে মহামারিতে রূপান্তর হয়ে ভয়াবহ আকার ধারন করবে। চীন, রাশিয়া, জাপান, আমেরিকা, ইউরোপসহ অনেক দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেশি রয়েছে। যার ফলে সেই দেশগুলোতে বেকারত্বের হার আমাদের দেশের চেয়ে অনেক কম। বর্তমানে যে কলেজগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরের জন্য অযৌক্তিক আন্দোলন চলমান রেখেছে সেই কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর না করে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রুপান্তর করা যেতে পারে। এতে দেশে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটবে এবং কিছুটা হলেও বেকারত্ব কমে আসবে। সেইসঙ্গে দক্ষ জনবল দেশেই তৈরি হবে।

লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুর।

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close