আরাফাত আশওয়াদ ইসলাম
মুক্তমত
গুমের প্রতিকার ও ন্যায়বিচারের প্রয়োজনীয়তা

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত; দেরিতে হলেও আমাদের রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে। কোনো জাতির ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত বারবার আসে না। তাই এই সুযোগের সদ্ব্যবহার আমাদের সবার কাম্য।
মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র সংস্কারের পূর্বশর্ত সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা। অতীতের ক্ষত নিরাময় ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারে দৃঢ় পদক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন। বিশেষত গুমের শিকার ব্যক্তিবর্গ ও তাদের পরিবারের অকল্পনীয় যন্ত্রণার যত দ্রুত সম্ভব উপশম প্রয়োজন। কারণ, সবচেয়ে ভয়াবহ অন্যায়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নিকৃষ্ট হচ্ছে বলপূর্বক অন্তর্ধান। এটি কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা থেকেই বঞ্চিত করে না; তার নিজের ও পরিবারকেও অকল্পনীয় যন্ত্রণার সম্মুখীন করে।
গভীর হতাশা ও উদ্বেগের বিষয়, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধানের অনেক ঘটনা ঘটেছে। জাতীয় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার দোহাই দিয়ে অপহরণ, গোপন আটক এবং বিচারবহির্ভূত শাস্তির পদ্ধতিগত অভিযান প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী। এমনকি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের সম্মুখীন ব্যক্তিদের তো আটক ও কারান্তরীণ করা হয়েছেই; তাদের সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা কেবল পারিবারিক পরিচয় ও সম্পর্কের কারণে গুমের শিকার হয়েছেন। কাউকে কাউকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর গুম করে রাখা হয়েছে।
যেমন- একজন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিককে নিছক অনলাইনে লেখালেখির কারণে সড়ক থেকে অপহরণ করে বিনা বিচারে দেড় বছর গোপন বন্দিশালায় আটক রাখা হয়। আরেকজন ‘সোর্ড অব অনার’ পাওয়া অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে দীর্ঘ আট বছর তার পরিবারকে না জানিয়ে বন্দি রাখা হয়।
রাজনৈতিক কর্মী, ধর্মীয় নেতা, সাংবাদিক, ব্লগার, কার্টুনিস্টদেরও বিচারবহির্ভুতভাবে আটক করে বন্দি রাখা হয়েছিল কেবল এমন মতামত প্রকাশ করার কারণে, যা শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। এদের কেউ কেউ জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর মুক্তি পেয়েছেন। কারো কারো খোঁজ এখনো অজানা।
এটা স্পষ্ট, গুমের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ ছিল না; বরং নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার ওপর পরিকল্পিত আক্রমণের অংশ ছিল। এ ধরনের যে কোনো ঘটনাই প্রতিহত করা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবাদমাধ্যম, নাগরিক সমাজের সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব ছিল। কিন্তু সেই দায়িত্ব কতটা প্রতিপালিত হয়েছে?
কল্পনা করুন, আপনার জীবনের এক দশক একটি অন্ধকার কক্ষে হারিয়ে যাচ্ছে; পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, নির্যাতনের শিকার; এমনকি সবচেয়ে মৌলিক মানবাধিকারগুলো থেকেও বঞ্চিত। কল্পনা করুন একজন মায়ের যন্ত্রণা, যিনি জানেন না- তার ছেলে বেঁচে আছে না মৃত, অথবা পিতা ছাড়া বেড়ে ওঠা একটি সন্তানের হতাশা। এই পরিস্থিতির মধ্যেও অনেক পরিবারকে তাদের প্রধান উপার্জনকারী হারিয়ে অর্ধপাগল অবস্থায় জীবনযাপনের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছে।
এগুলো বিমূর্ত ট্র্যাজেডি নয়; গুমের শিকার পরিবারগুলোর জীবিত বাস্তবতা। গুমের শিকার ভুক্তভোগী পরিবারগুলো যে যন্ত্রণা সহ্য করেছে তার একটি আন্তরিক, দ্ব্যর্থহীন স্বীকৃতি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আসা উচিত। এর সঙ্গে এমন একটি প্রতিশ্রুতি থাকা উচিত, যাতে এ ধরনের নৃশংসতা আর কখনো না ঘটে। রাষ্ট্রকে অবশ্যই ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসনেও পদক্ষেপ নিতে হবে, তাদের জীবন পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।
অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে এক অনন্য সুযোগ এসেছে। ন্যায়সংগত সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নোবেলজয়ী সরকারপ্রধানের কাছে অন্য যে কোনো জাতীয় নেতার তুলনায় জনগণের প্রত্যাশা বেশি। তার সরকারকে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়গুলোর মুখোমুখি হওয়ার জন্য এবং একটি নতুন পথ তৈরি করার জন্য এই মুহূর্তটি কাজে লাগাতে হবে। এতে ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তি স্থাপিত হবে। যত দ্রুত এসব পদক্ষেপ কার্যকর করা যাবে, তত দ্রুত বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হবে। লেখক : কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, গুলশান সোসাইটি
"