নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার

  ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

দৃষ্টিপাত

শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার কেন জরুরি

সংস্কার আর সংস্কার। চারদিকে শুধু সংস্কার। এ সংস্কারকে সামনে রেখে মানুষের কত প্রত্যাশা। তবে এ সংস্কারকে সার্থক ও কার্যকরী করে তুলতে হলে সবচেয়ে বেশি সংস্কার প্রয়োজন শিক্ষায়। কিন্তু এদিকে সূর্য ওঠার কোনো লক্ষণ নেই। তাই মনে প্রশ্ন জাগে- টেকসই হবে তো সংস্কার?

সরকারকে সফল করার লক্ষ্যে সংস্কারমূলক কার্যক্রমকে ঘিরে বর্তমান সরকার তার যাবতীয় কাজকর্ম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিছু মানুষ এ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। আশায় রয়েছে সামনে হয়ত অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের সুবাতাস বইবে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন খাতের সংস্কারের জন্য ১১টি সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি কমিটি তাদের রিপোর্ট প্রদান করেছে সরকারের কাছে। কমিটির প্রস্তাবিত বিষয় নিয়ে মানুষের মধ্যে চলছে বিশ্লেষণ। বাকি কমিটিগুলো বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যেই হয়ত তারা সংস্কারের রূপরেখা উপস্থাপন করবেন। আর এ রূপরেখার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট খাতের সংস্কার করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো- এ যে সংস্কারের কথা আমরা বলছি, সেটা আসলে কী? সংস্কার আমাদের কতটুকু সফলতা এনে দেবে, যদি আমরা সংস্কারের পক্ষে অবস্থান না নিই। কারণ এখনো আমাদের দেশের ৮০ ভাগ গ্রামীণ মানুষের এ নিয়ে কোনো ধ্যানধারণা নেই বললেই চলে। তারা চায় পেটভরে খেতে এবং শান্তিতে ঘুমাতে। তথাপি সংস্কারের প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৩ বছর আগে। এখনো আক্ষেপে বলে থাকি কী পেলাম এ স্বাধীনতায়।

অবশ্য সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীনতার সময় আমরা যেভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবেছিলাম, তা থেকে আমরা আজ অনেকাংশেই সরে গেছি। তখনকার সময়ের মানুষের চাহিদা আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানুষের চাহিদার মধ্যে রয়েছে ব্যাপক ফারাক। তাই সাধারণ মানুষ যদি এ সংস্কার সমন্ধে ধারণা না পায়, তাহলে বর্তমান সরকারের সংস্কারের চিন্তা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারবে না। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কাঠামোতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া হলো সংস্কার। রাষ্ট্রের মাঝে সুশাসন বৃদ্ধিই এর মূল লক্ষ্য। সুশাসন বৃদ্ধি পেলেই কেবল অন্যান্য কাজ সঠিক পথে এগিয়ে যাবে। আমাদের মতে, পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হলে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি জরুরি, তাহলো শিক্ষা।

কিন্তু সব সংস্কার টেকসই হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহন যে শিক্ষা, এটা মনে হয় আজো আমাদের বুঝতে বাকি রয়েছে। আমরা অনেক হতাশ হয়েছি এ কারণে যে, শিক্ষা সংস্কারের বিষয় নিয়ে আজ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি এবং শিক্ষায় সংস্কার নিয়ে কোনো প্রকার কমিশন গঠিত হবে কি না, তাও পরিষ্কার করা হয়নি। এরই মধ্যে যেসব সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে, তার প্রত্যেকটিতেই গুণী লোকদের সন্নিবেশন করা হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা আজ কোন পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে, তা নিয়ে দায়িত্বশীল লোকদের যেন কোনো চিন্তা করার সুযোগ নেই! বর্তমান পরিস্থিতি দেখে তা-ই মনে হয়।

বিগত ২৫ বছরের মধ্যে শিক্ষা নিয়ে এত ছেলেখেলা করা হয়েছে যে, শিক্ষার মূল লাইনটাই হারিয়ে ফেলেছে বলে মনে হয়। কোনো গবেষণা ছাড়াই শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন করা হয়েছে বারবার, যার ফলে শিক্ষার বারোটা বাজানো হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে বারবার এ ব্যবস্থার মধ্যে পেরেক মারা হয়েছে। বিভিন্ন সময় এসব পরিবর্তনের নামে লুটপাট করা হয়েছে অর্থ। শিক্ষার অনেক কমিশন গঠিত হলেও এর রিপোর্টের অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা হয়নি। যার যখন যেটুকু প্রয়োজন হয়েছে, তা-ই করেছে। যখন নতুন কোনো পদ্ধতি আনা হয়, তখন সে পদ্ধতিকে সময় না দিয়েই আবার নতুন ব্যবস্থা আনা হয়েছে। আর যারা এসব ব্যবস্থা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করবেন, তাদের কোনো প্রশিক্ষণ না দিয়েই এ ব্যবস্থা শিক্ষকদের ওপর চাপানো হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নয়ন না ঘটিয়ে কেবল দায়সারা কাজটা করেছে সরকার। বারবার একটি কথাই বলা হয়েছে, সরকারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা। সরকার সবসময় শিক্ষা খাতের বরাদ্দকে ব্যয় হিসেবেই দেখিয়ে আসছে। কখনো চিন্তা করেনি যে, এটা রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।

এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, শিক্ষাব্যবস্থায় অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দালানকোঠা বেড়েছে। বর্তমান সময়ের শিক্ষাব্যবস্থায় কেবল শিক্ষার্থী বাড়ানো এবং পাস করিয়ে দেওয়ার প্রতি এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, তাতে করে জানার জায়গাটা শিক্ষার্থীর কাছে অর্থহীন হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষাব্যবস্থায় চাকরির বাজারে সরকারি চাকরিকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় শুরু হয়েছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এক্ষেত্রে শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার জন্য বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এজন্য সরকার শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে কার্যকর উদ্যোগ নেবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি। এ সরকারের বেলায় কোনো দলমতের আদর্শ থাকতে পারবে না।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক। প্রভাষক, আলীনগর কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজ, ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close