মো. তাহমিদ রহমান

  ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

দৃষ্টিপাত

কথার পাহাড় নয়, চাই কল্যাণময় রাষ্ট্র

একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি তথা মেরুদণ্ড হচ্ছে সরকার। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ নিয়ে সরকার রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটিকে পরিচালনা করে থাকে। আর এ সব বিভাগ পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ। তাই দেশের সুষম উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সৎ, দক্ষ ও বিচক্ষণ হওয়া একান্ত জরুরি। সেইসঙ্গে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও সুষম উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও জরুরি। দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার পাশাপাশি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাও থাকতে হবে। কালস্রোতের প্রবহমান ধারায় সারা বিশ্বের বুকে নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে চব্বিশের বাংলাদেশ। রাজনীতিবিদদের নানা অপকর্মে অনাবিল সুন্দর শোভাময় এই দেশটি প্রতিযোগিতাময় বিশ্ব থেকে প্রায় সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছে। দেশটির প্রান্তিক জনগোষ্ঠী স্বস্তিতে নেই। পরিগণিত হয়েছে শোষণ-বঞ্চনার শিকারে। অমানবিক বৈষম্যে নিষ্পেষিত হয়েছে তারা। রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ভোগবাদী রাজনীতিবিদেরা কখনো জনগণের বন্ধু হয়নি তারা বন্ধু হয়েছে কতিপয় ধনী বণিক শ্রেণির।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সর্বাধিক আলোচ্য বিষয় হচ্ছে অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র যা সাধারণ জনগণের কাছে বিগত সরকারের ছত্রছায়ায় মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের অবাধ লুটপাটের দলিল বলে গণ্য। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়ায় জনসম্পৃক্ত বিষয়গুলোতে জনস্বার্থ ও জনকল্যাণের কিছুই ছিল না। ভাগবাটোয়ারা শেষে জনগণের জন্য যা ছিল তা হচ্ছে নিপীড়ন আর অস্বস্তিদায়ক ভোগান্তি। ইতোপূর্বে রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগে যে সব অর্থনৈতিক বা কল্যাণমুখী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। নির্বাচনী সভায় প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিতে বিগত সরকার প্রধান ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার মতো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতেও দ্বিধাবোধ করেননি। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদের সবচাইতে বড় সুবিধা হল এদেশের আমজনতার স্মৃতিশক্তি স্বভাবতই ক্ষীণ। ফলে রাজনীতিবিদেরা নির্বাচনের আগে হাজারো আশার বাণী শোনালেও ভোটের ফলাফল বের হওয়ার পর সে কথা মাথায় রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। নির্বাচনকালীন সময়ে দেশের জনগণ চলমান ঘটনাগুলোকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো দীর্ঘমেয়াদী বিষয়গুলো সবসময় উপেক্ষিত থেকে যায়।

দুর্নীতি ও অর্থ পাচার দেশের সার্বিক উন্নতিতে চরম অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরিব মানুষের টাকা লুটপাট হয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমেই কিছু মানুষ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনেছে। ১০ শতাংশ মানুষ দেশের ৮৫ শতাংশ সম্পদের মালিক হয়েছে। বিগত সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী দূর্নীতিবাজদের অবস্থা বুঝাতে একবার বলেছিলেন আগে পুকুর চুরি হত এখন সাগর চুরি হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার কর্তাবাবুদের মনে রাখা উচিত সব প্রতিশ্রুতি জনগণ কিন্তু ভুলে না শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, বেকারত্ব দূরীকরণ এবং বৈষম্যহীন উন্নয়নে জনগণ এখন সদা সচেতন। বিগত ৫৪ বছরে সরকারের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক ছিল, তারা রাজনীতির মাধ্যমে আইনের ঊর্ধ্বে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মহানায়ক ছিলেন। প্রায় ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিজীবীদেরকেও নিজেদের সুবিধা প্রাপ্তিতে ব্যবহার করতেও দ্বিধা করেননি।

ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বর্তমানে দেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় পার করছে। দেশের সর্বস্তরের জনগণের ওপর দীর্ঘকাল ধরে চলা সব ধরনের বৈষম্য দূর করে একটি ন্যায়নিষ্ঠ, বৈষম্যহীন, কল্যাণকামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মানুষ স্বপ্ন দেখছে। বিগত ৫৪ বছরে নির্বাচিত, অনির্বাচিত, সেনাশাসনসহ বিভিন্ন সরকারের সময়গুলোতে জনগণের অধিকার হরণ, অস্ত্রচালান, গণহত্যা, শেয়ারবাজার ও ব্যাংকখাত থেকে অর্থ লোপাট, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বালখিল্যতা, গণমাধ্যমকে কুক্ষিগত করাসহ নানা ঘটনা এদেশের অসহায় জনগণ দেখেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে সরকার পরিচালিত সিন্ডিকেটগুলো লাভবান হয়েছিল। জনগণের কষ্ট ও মতামত বলার কোনো অধিকার ছিল না। খাদ্য দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতেও জনগণ কথা বললে স্বয়ং সরকার প্রধান বিভিন্ন রেসিপির উদয় ঘটিয়ে জনগণের সাথে পরিহাস করেছেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বেকারত্বের সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে কখনোই দেখা যায়নি। মাঠ পর্যায়ে কৃষকের কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কোনো উদ্যোগ কখনোই দৃশ্যমান হয়নি। বাংলাদেশের জনগণের দুর্ভোগের মূল কারণ শাসকগোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অপব্যবহার। ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে তারা সম্পদের পাহাড় গড়তে চায়। জনগণের জীবনমান উন্নয়নে তাই খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। এমনকি চাকরি পাওয়ার জন্য প্রার্থীদের মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য করা হয়। টিআইবি বাংলাদেশের ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্নীতিগ্রস্ত খাতের তথ্য প্রকাশ করেছে সেই রিপোর্টে ক্রমান্বয়ে রয়েছে পাসপোর্ট অফিস, বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এমনকি বর্তমান পরিস্থিতিতেও পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে ঘুষ গ্রহণ বন্ধ হয়নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত করে রাখা হয়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ শিক্ষক সমাজের জীবনমান উন্নয়নে অর্থনৈতিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি।

জাতিগঠনের পিছনে যে শিক্ষক সমাজ অক্লান্ত পরিশ্রম করে তারা বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা এমনকি ঈদ বোনাস থেকেও বঞ্চিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ। রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়শই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিণত করে যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে। উন্নয়ন হচ্ছে পরিবর্তন, যা হবে ইতিবাচক তাই রাষ্ট্রব্যবস্থার দায়িত্ব হবে জনগণ যেন যেকোনো পরিস্থিতিতে স্বাধীন চিন্তা এবং তার মতামত ব্যক্ত করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বলার মতো অনেক উন্নতি আছে। বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ড অনুযায়ী ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে আমরা নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে আমরা মাথাপিছু আয় ও সামাজিক সূচকগুলোর মধ্যে প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগিয়ে। শত প্রতিকূলতার মাঝেও বাংলাদেশের জনগণের অক্লান্ত পরিশ্রম ও হার না মানা মানসিকতার জন্য দেশটি বিশ্বের কাছে এক বিস্ময় হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। শান্তি, সমৃদ্ধি ও মানুষের কল্যাণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবদান থাকতে হবে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের জন্য।

সব অনগ্রসর শ্রেণির মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু বিগত দিনে আমরা দেখেছি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ছত্রছায়ায় অর্থনৈতিকভাবে ফুল ফেঁপে উঠেছে একটি বিশেষ শ্রেণি কিন্তু সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠী যেমন: বেদে, হরিজন, সুইপার, তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিক, চা শ্রমিক, প্রতিবন্ধীতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনগণ, প্রবীণ নাগরিকরা রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দেশের সকল নাগরিকের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য জিডিপির প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, বেকারত্ব দূরীকরণ, কর্মমুখী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, গড় আয়ু বৃদ্ধি, সরকারি ভাবে যথাযথ চিকিৎসা লাভ, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ, প্রতিবন্দীতা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রীয় শেল্টার হাউস নির্মাণ, ক্রমবর্ধমান প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রীয় ভাবে একটি শক্তিশালী যত্ন ও পরিচর্যা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা নিশ্চিত করতে এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও সততাকে গুরুত্ব দিতে হবে।

লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র, শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে এবং যত্রতত্র শাখা-প্রশাখা কমিটি গঠন বন্ধ করতে হবে। একটি সম্ভাবনাময়, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে অব্যাহত থাকুক বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বৈষম্য, বঞ্চনা মুক্ত হয়ে দেশে বিরাজ করুক সুখ, শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি। সংবিধানের আলোকে সকল নাগরিকের জন্য নিশ্চিত হোক আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সাম্য ও সুবিচার। সর্বোপরি রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনীতি হোক দেশের কল্যাণের জন্য। যেখান থেকে উপকৃত হবে পুরো জাতি।

লেখক : প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ)।

নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা।

ঃধযসরফৎধযসধহ৪২৪@মসধরষ.পড়স

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close