মোহাম্মদ আল এমরান

  ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

বিশ্লেষণ

কর-জিডিপি রেশিও : রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন

বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিবর্তন নব্বই দশকের পর থেকেই শুরু হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্পের পাশাপাশি নতুন নতুন শিল্প-কারখানা ও অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে এদেশের জিডিপির আকার ক্রমান্বয়ে বৃদ্দি পাচ্ছে। এদেশে ৫৩ বছর পরে জিডিপির আকার যা দেখা যাচ্ছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার কোনো অবকাশ নেই। মিডিয়ার রিপোর্টে দেখা গেছে, এদেশের জিডিপির আকার ২০৩০ সালনাগাদ উন্নত বিশ্বের কিছু কিছু ধনী রাষ্ট্রের চেয়েও বৃদ্ধি পাবে। বৃদ্ধি পাওয়ার তো কথা, কারণ এদেশে রয়েছে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ দশমিক ৯৮ শতাংশের অধিক বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত কর্মক্ষম জনবল। এদেশের জনগণের জন্য যদি আরো বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসার বিস্তার ও কর্মক্ষেত্র তৈরি করা যায় তাহলে ২০৩৫ সালের মধ্যেই এদেশের জিডিপি এক ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো অসম্ভব কিছু নয়। সম্ভাবনার হাতছানি রয়েছে দেশের সবক্ষেত্রে, শুধু লটুপাট, দুর্নীতির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারলেই হবে। মেগা মেগা অবকাঠামো তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করছে দাতা সংস্থাগুলো। এর মধ্যে কোনো কোনো অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করলে দেশের জিডিপি অতি দ্রুত বৃদ্ধি পাবে তা নির্ধারণ করে যদি বিনিয়োগ করা যায় তাহলে এদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বছরে ১০ শংতাশ করে বাড়ানো অসম্ভব কিছ না। পার্শ¦বর্তী ভারতের এত সংকুলতা থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিগ্রহের সময়ও জিডিপি ৭ শতাংশের উপরে রেখেছে। এক্ষেত্রে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। ভারতের মোদি সরকারও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মতো মনে হয় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর পরিসংখ্যান ও হিসাব-নিকাশ সর্বদা সঠিক থাকে। আমেরিকার জিডিপিও কিন্তু প্রায় ৫-৬ শতাংশ করে প্রতি বছর উন্নীত হচ্ছে। ভারতের ক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রভাবের ফলে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা।

আমাদের দেশের জিডিপির আকার বিগত সরকারের হিসাব অনুসারে গত অর্থবছরে ছিল ৪৪৯ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এদেশের হিসাব-নিকাশ কোনো জায়গায় সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। দেশের ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ১ শতাংশ। বিগত সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধার্য করেছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ হতে মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হওয়া দেশের জিডিপি ১০ শতাংশ করে বাড়ানো সহসাই সম্ভব। দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ যদি বাড়ানো যায় আর জিএনপির প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়ে থাকে পাশাপাশি দেশে কর্মসংস্থান এবং নতুন নতুন উৎপাদনমুখী শিল্প ও রপ্তানি খাতের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা আমাদের এখন মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

আমাদের দেশের অর্থনীতি এখনো কৃষিনির্ভর। শতকরা ৪৪ দশমিক ৪২ ভাগ মানুষ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি দিয়েই দেশের ক্রমাগত জিডিপি বৃদ্ধি পাচ্ছে। হিসাব-নিকাশে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির ডেটা খুব সহজে পাওয়া যায় ফলে সরকারের কৃষি হতে প্রাপ্ত জিডিপির পরিমাণ নির্ণয় করা সহজ, কিন্তু তৈরি পোশাক, আবাসন, নির্মাণ শিল্প, সেবা, অবকাঠামো নির্মাণ আর্থিক খাত, প্রযুক্তি, টেলিকম ও বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের ভ্যালু সংযোজন করা খাতসমূহের জিডিপিতে ভূমিকা যে নগণ্য নয়, তার বাস্তবতা বিগত সরকার উপলব্ধি করেছেন। বিগত সরকারের হিসাব-নিকাশ যদি ভুল হয়ে থাকে, এরপরে বর্তমান সরকারের হিসাব অনুসারে যদি জিডিপির আকার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক হয়ে থাকে এবং প্রতি বছর জিডিপি যদি ১০-১১ শতাংশহারে বাড়ানো যায় তাহলে বার্ষিকহারে বাংলাদেশের জিডিপি ২০৩৫ সালে এক ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব। এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলো-মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতার, কুয়েত, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম কিন্তু তাদের উৎপাদনমুখী অর্থনীতি ও সুষম বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করে এখন পর্যন্ত উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে।

আইএমএফ হতে ঋণ পেতে হলে বিশেষ কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। তাদের বিশেষ শর্তগুলোর মধ্যে একটি হলো আমাদের দেশের কর-জিডিপি রেশিও বাড়াতে হবে। যা বর্তমানে ৮ শতাংশের নিচে এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কর-জিডিপি রেশিও ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। যা গত বছরের ১১ দশমিক ২ শতাংশ হতে বেড়েছে। আগামী বছর ১১ দশমিক ৭ শতাংশ পৌঁছানোর অনুমান রয়েছে।

গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরের মতে, রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত ২০-২৩ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান মুক্ত অর্থনীতির দেশের কর-জিডিপি রেশিও ১৬-১৭ শতাংশ উন্নীত করার জন্য যত ধরনের পদক্ষেপ দরকার তা গ্রহণ করা উচিত। ভ্যাট ও কর না বাড়লে টাকার মান কমে যায়। রাজস্ব ঘাটতির ফলে সরকারের ঋণ নিয়ে দেশ চালাতে হয়। সরকারের ব্যয় মেটাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে টাকাও ছাপাতে হয়। ফলে মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রতি অর্থবছর টার্গেটের চেয়ে কম কর এনবিআর হতে আদায় হচ্ছে। কেন? এখন তো করের আওতায় এসেছে-এমন প্রতিষ্ঠান ও শিল্পের সংখ্যা নগণ্য নয়। কর নিবন্ধনের সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সংখ্যা বাড়েনি। নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশে ৭০ লাখের অধিক প্রত্যক্ষ করদাতা রয়েছে। প্রত্যক্ষ করদাতার পরিমাণ ১ কোটির চেয়ে বেশি বাড়াতে মাত্র ১ বছরের বেশি সময় লাগার কথা না।

রাজস্ব আয় হলো একটি দেশের চালিকাশক্তি ও প্রাণ। আনলিমিটেড চুরিতে ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। প্রতি বছর ১.৭ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে বিগত সরকারের আমলে, এটি যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এ পরিমাণ অর্থ যদি দেশে বিনিয়োগ করা হত তাহলে দেশের জিডিপি ১০ শতাংশ করে বৃদ্ধি করা কোনো কাল্পনিক ও অবাস্তব কোনো বিষয় নয়। রাজস্ব আদায়ও ১৫-১৬ শতাংশ অনায়াসেই সম্ভব যদি জেলাভিত্তিক এনবিআর-রাজস্ব আদায়ের টার্গেট তৈরি করে। আমাদের দেশে কেন্দ্রভিত্তিক বা প্রধানত বিভাগীয় শহর হতে রাজস্ব আদায় পরিচালিত হচ্ছে। সিটি করপোরেশনগুলো নামে মাত্র রাজস্ব আদায় করছে। চাঁদাবাজির কারণেও রাজস্ব আদায় কমে গেছে। সরকারের সেবা ও মানের সঙ্গেও রাজস্ব আদায়ের সম্পর্ক রয়েছে। সরকারি অফিস-আদালতে যে পরিমাণ দুর্নীতি ও ঘুষবাণিজ্য হচ্ছে, যার কারণে সেবা খাত হতে রাজস্ব আদায় সেই পরিমাণ সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশ ও আইনজীবীরা সেবার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।

প্রত্যক্ষ কর রিটার্ন দিতে ব্যবসায়ী অনীহা প্রকাশ করছে, কারণ ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে গিয়ে চাঁদাবাজির কবলে পড়ছে। সোজা কথা যে পরিমাণ অর্থ অবৈধ উপায়ে পুলিশ, প্রশাসনের কিছু ঘুষখোর সিন্ডিকেট ও সন্ত্রাসী, গুণ্ডাপাণ্ডা যেভাবে রাস্তাঘাট, ফুটপাত, হাট-বাজার, বিভিন্ন নির্মাণধীন অবকাঠামো হতে চাঁদাবাজি করছে- তা মনে হয় দেশের এনবিআর।

লেখক : ব্যাংকার, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী।

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close