মো. ফাহিম আলী
দৃষ্টিপাত
রাজনৈতিক সংকটের বলয়ে দক্ষিণ এশিয়া

জটিল রাজনীতি এবং বহুমুখী বাস্তবতায় দক্ষিণ এশিয়া এখন বৈশ্বিক শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার মঞ্চ এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সংকটের ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সীমান্ত সংঘাত, সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং আঞ্চলিক শক্তির প্রতিযোগিতা বর্তমান সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে অস্বচ্ছ ও অনিশ্চিত করে তুলেছে। অঞ্চলটির বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি এবং সিদ্ধান্তহীনতার পরিবেশ, যা প্রায়শই রাজনৈতিক সহ সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ঐতিহাসিক কারণগুলোর সঙ্গে জড়িত।
সীমান্ত-সংঘাত : উপনিবেশ-উত্তর সীমান্ত সমস্যা ও সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার অন্যতম কারণগুলোর একটি। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের কয়েকটি সীমান্তে, বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও লালমনিরহাটে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কয়েকটি স্থানে নির্মাণ কাজে বিজিবি কর্তৃক আপত্তি তোলার পর সীমান্তে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ভারতীয়রা জিরো লাইন থেকে দেড়শ গজের মধ্যে নির্মাণ কাজ শুরু করে, যা উভয় দেশের সমঝোতা অনুযায়ী হওয়ার কথা। আবার প্রসঙ্গত, তিন বিঘা করিডোর নিয়ে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ বেরুবাড়ী ভারতকে হস্তান্তর করলেও ভারত তিন বিঘা করিডোরের পূর্ণ কর্তৃত্ব বাংলাদেশকে দেয়নি। তাছাড়াও গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তিতেও বাংলাদেশ প্রাপ্য ফল থেকে বঞ্চিত। আর এই সীমান্ত দ্বন্দ্বের ফলে কূটনৈতিক অসম্মান ও সম্পর্কের অবণতি ঘটে। সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মির দখলদারিত্ব ও রোহিঙ্গা সংকট দেশের সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য বঢ় ধরনের হুমকি।
অন্যদিকে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যেও সীমান্ত সংঘর্ষ লক্ষ্যণীয়। বিরোধপূর্ণ ডুরাল্ড লাইনের নিকটবর্তী দুই এলাকায় নতুন করে সৃষ্ট চলমান সংঘর্ষ দেশ দুটির মধ্যে সীমান্ত অঞ্চল নিয়ে বিরাজমান উত্তেজনাকে আরো তীব্র করে তুলেছে। সম্প্রতি আফগানিস্তানের পাকতিয়া প্রদেশে পাকিস্তানের বিমান হামলা পরিস্থিতিকে নয়া রূপ দান করে। পাকিস্তানের দাবি অনুযায়ী, আফগানিস্তানের সহায়তায় পাকতিয়া প্রদেশে সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান সদস্যদের অবস্থানের কারণে সীমান্তে নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলায় তারা বিমান হামলা চালায়। অভিযোগ অস্বীকার করে হামলার প্রতিবাদে তালেবান পাকিস্তানের কয়েকটি সীমান্ত চৌকিতে হামলা চালায়। যার ফলে উভয় অঞ্চলেই পরিস্থিতির অবণতি দেখা যায়। তাছাড়াও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার অন্যতম খড়মরংঃরপ ঐঁন হিসেবে আফগানিস্তানের অন্তর্গত ওয়াখান করিডোর নিয়ে পাকিস্তানের বিরোধপূর্ণ দৃষ্টি বিদ্যমান।
আবার ভারত এবং পাকিস্তান বিশেষত কাশ্মীর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধে জড়িত। পারমাণবিক শক্তিধর হওয়া সত্ত্বেও কাশ্মীরের বিতর্কিত অঞ্চল, সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ, সীমান্তের উত্তেজনার কারণে দেশ দুটির সম্পর্কের মধ্যে শত্রুতা বিদ্যমান। উভয় দেশ এই অঞ্চলে সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য একাধিকবার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালালেও, তাদের সম্পর্কের মধ্যে একাধিক যুদ্ধ এবং উত্তেজনা বিরাজমান।
অন্যদিকে সীমান্ত সংক্রান্ত বিতর্ক লাদাখ এবং অরুণাচল প্রদেশে চীন ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। ২০২০ সালের গালওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের রক্তক্ষয়ী সেনা সংঘর্ষের পর সম্প্রতি চীনের উত্তর-পশ্চিমের জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত সরকার নতুন দুটি প্রশাসনিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলে পুনরায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। অঞ্চল দুইটি ভারতের লাদাখের অংশ হওয়ায় চীনের এই অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ লক্ষ্যণীয়। তাছাড়া ডোকলাম উপত্যকা নিয়ে চীন ও ভুটানের মধ্যেও দ্বন্দ্ব রয়েছে। অঞ্চলটিতে কৌশলগত স্বার্থে ভারতের চীন বিরোধী কার্যকলাপও বিদ্যমান। আবার নেপাল ও ভারতের মধ্যেও কালাপানি এবং লিপুলেখ অঞ্চলের সীমান্তের কিছু অংশ নিয়ে বিরোধ রয়েছে। উভয়ই এই অঞ্চলগুলো তাদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে। আর এসব সীমন্ত দ্বন্দ্বের ফল হলো দেশগুলোর মধ্যে কূটনীতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কে স্থবিরতা।
আঞ্চলিক শক্তির প্রতিযোগিতা ও সংহতির অভাব : দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের চলমান লড়াই অস্বচ্ছ রাজনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
অবকাঠামো, বাণিজ্য প্রসার এবং বিনিয়োগের সংযোগ জোরদারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে অন্যদের প্রভাব সীমিত করার লড়াইয়ে ব্যস্ত। দেশগুলোর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের চেয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রতি বেশি নির্ভরশীলতা রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া চীন (প্রতিবেশি হিসেবে প্রভাব ফেলে) ও ভারতের দীর্ঘদিনের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রস্থল। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (ইজও) এবং ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির মধ্যে প্রতিযোগিতা এই অঞ্চলকে কৌশলগতভাবে প্রভাবিত করে। তাছাড়া Gateway to central Asia হিসেবে ইরানের চাবাহার বন্দর নিয়ন্ত্রণে ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতা লক্ষ্যণীয়। আর এই প্রতিযোগিতায় অন্য দেশগুলো ঋণফাঁদ কূটনীতি, কৌশলগত চাপ, উন্নয়ন প্রকল্পের লোভে নানা ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। অবকাঠামো উন্নয়ন ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতির কারণে ছোট দেশগুলো একাধিক পক্ষের প্রকল্পে যুক্ত হয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং ঝঃৎধঃবমরপ অঁঃড়হড়সু বাস্তবায়নে সক্ষমতা হারায়। সম্পদ দখল যেমন- জলসম্পদ, খনিজ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো সম্পদের দখল নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় জলসম্পদ ব্যবহারের প্রশ্নে ভারত-বাংলাদেশ এবং ভারত-নেপালের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। তাছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশগুলো ঞৎধহংরঃ ধহফ খড়মরংঃরপ ঐঁন হওয়ায় আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কাছে ঘবড়-পড়ষড়হরধষরংস স্থাপনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সংস্থাগুলো (ঝঅঅজঈ, ইওগঝঞঊঈ, অঈট) বিভিন্ন উদ্দেশ্যে গঠিত হলেও রাজনৈতিক মতপার্থক্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, অপর্যাপ্ত সংস্থান ও পরিকল্পনা এবং বহিরাগত প্রভাবের কারণে কার্যকর হতে ব্যর্থ। যার ফলশ্রুতিতে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাট আকারে প্রতীয়মান হয়।
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব : বর্তমানে এই অঞ্চলের প্রতিটি দেশই নিজস্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সাম্প্রতিক সময়ে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরেও অভ্যন্তরে নানা বিশৃঙ্খল কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক চাপ এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা দেশের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় মেরুকরণ, কৃষক আন্দোলন এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে বিতর্ক রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এছাড়া, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ এবং আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা দেশের স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করছে।
পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক হস্তক্ষেপ এবং সন্ত্রাসবাদের সমস্যায় জর্জরিত। ২০২২ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাচ্যুতি এবং তার পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করেছে। অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারত্ব দেশের স্থিতিশীলতাকে আরো বিপন্ন করেছে। আফগানিস্তানও দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সশস্ত্র সংঘর্ষ এবং সন্ত্রাসবাদের শিকার। দেশটিতে তালেবান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর সৃষ্ট সীমান্ত দ্বন্দ্ব এবং আন্তর্জাতিক সহায়তার অভাবের কারণে গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ, অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং আর্থিক সংকট দেশের স্থিতিশীলতাকে বিপর্যস্ত করছে।
শ্রীলঙ্কা সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয়েছে। ঋণ সংকট, মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি দেশের জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়েছে। অন্যদিকে নেপালে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং সরকার পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। সংবিধান সংশোধন ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নিয়ে বিতর্ক দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। মালদ্বীপেও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ক্ষমতার লড়াই দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে। পর্যটননির্ভর অর্থনীতিতে মহামারির প্রভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। আবার ভুটান তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকলেও, আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং অর্থনৈতিক নির্ভরতা দেশের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার চলমান এই রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশগুলোতে গণতন্ত্রের সংকট গভীরতর হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা এই সংকটকে বাড়িয়ে তুলছে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগ হ্রাস, বেকারত্ব বৃদ্ধি, এবং মুদ্রাস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে। তাছাড়াও কাশ্মীর ইস্যু, রোহিঙ্গা সংকট এবং সংখ্যালঘু নির্যাতন সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে। উরঢ়ষড়সধঃরপ ঊয়ঁরষরনৎরঁস এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালীকরণ, আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, এবং অর্থনৈতিক সংস্কার এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহযোগিতা এই অঞ্চলের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
"