ড. হারুন রশীদ

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

মতামত

গণপরিবহন খাতে সংস্কার কবে?

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গণপরিবহন সেক্টরে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন ছিল প্রত্যাশিত। এ সরকার সংবিধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিশনও গঠিত হয়েছে। কমিশন ইতিমধ্যে রিপোর্টও জমা দেওয়া শুরু করেছে। তাই গণপরিবহনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে সংস্কারও ছিল জনআকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রে। কিন্তু পরিবহন খাত নিয়ে কোনো সংস্কার কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, গণপরিবহন খাতে সংস্কারটা তাহলে কবে?

গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা দুঃসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে অনেক আগেই। কোথাও যাওয়ার জন্য নাগরিকদের রাস্তায় নেমেই এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। গন্তব্যে যাওয়ার জন্য তাড়া আছে, যানবাহনের তীব্র সংকট। অফিসে যাওয়া, বাচ্চার স্কুল, বিয়ে-দাওয়াত, পার্টিতে যাওয়া, এমনকি রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া- প্রয়োজনীয় কোনো গন্তব্যেই যে সময়মতো পৌঁছানো যাবে, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। বাসে উঠতে গেলে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ট্যাক্সিক্যাব অপ্রতুল, ভাড়াও অতিরিক্ত।

সিএনজিচালিত অটোরিকশা মিটারবহির্ভূত বেশি ভাড়া নিয়েও প্রয়োজনীয় গন্তব্যে যেতে নারাজ। এর বাইরে বিকল্প যানবাহনও অপ্রতুল। এ অবস্থায় মানুষজনের ভোগান্তির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যানজটের কারণে তো রাজধানী স্থবির হয়ে থাকে অধিকাংশ সময়। অথচ একটি দেশের রাজধানীর কর্মচঞ্চলতা যদি এভাবে রাস্তাতেই নষ্ট হয়, তাহলে সেই দেশের ভূত-ভবিষ্যৎ যে কী, তা কি আর লেখার অপেক্ষা রাখে না।

যানজটের ফলে নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা, বাড়ছে রোগব্যাধি। শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণে নানা সংক্রামক ব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছে রাজধানীর বিপুলসংখ্যক মানুষ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, যানজটের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সব রুটে যাত্রীদের চলাচলে কমপক্ষে তিন কর্মঘণ্টা সময় অপচয় হয় প্রতিদিন যানজটের কারণে বিপুল পরিমাণ জ্বালানিরও অপচয় হয়। কিন্তু এ থেকে পরিত্রাণের যেন কোনো উপায় নেই। বিভিন্ন সময়ে নানামুখি কর্মসূচি-পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হলেও বাস্তবায়িত হয়েছে খুবই কম। ফলে সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সেখানেই রয়ে গেছে। অথচ দুর্বিষহ যানজটের জন্য পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতার অভাবকেই দায়ী করা হয়।

রাজধানীতে রাস্তার তুলনায় প্রায় ৩ লাখ যানবাহন বেশি চলছে। এছাড়া প্রতিদিন গড়ে ২৩০টি নতুন গাড়ি রাস্তায় নামছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী যে কোনো শহরে মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ যান চলাচলের জন্য রাস্তা থাকা আবশ্যক। ঢাকা শহরের মোট আয়তন ৮১৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার। এ হিসাবে ২০৪ কিলোমিটার রাস্তার প্রয়োজন হলেও ঢাকা শহরে প্রধান রাস্তার পরিমাণ মাত্র ৮৮ কিলোমিটার। এই পরিমাণ রাস্তায় ৫ লাখ যানবাহন চলাচল করছে। অথচ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এই পরিমাণ রাস্তায় ২ লাখ ১৬ হাজার যানবাহন চলাচল করার কথা।

সত্যি বলতে কি, ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় এক অরাজক অবস্থা বিরাজ করছে। জীর্ণশীর্ণ বাসগুলো সিটিংয়ের নামে ‘চিটিং’ করছে যাত্রীদের সঙ্গে। ব্যস্ত সময়ে লোকাল বাসগুলোও হয়ে যাচ্ছে সিটিং বাস। এতে একদিকে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে, অন্যদিকে লোকাল বাসে সিটিংয়ের নামে স্বল্প যাত্রী বহন করায় শত শত যাত্রীর অপেক্ষাকে আরো দীর্ঘতর করছে তারা। মানহীন ভাঙাচোরা রংচটাবাস, যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ নানা অনিয়মের বেড়াজালে যাত্রীদের বন্দি করছে। সেবা নয়, মুনাফাই এদের আসল উদ্দেশ্য। এ অবস্থায় একটি গতিশীল পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য রাষ্ট্রায়ত্ত বিআরটিসিকে সচল করতে হবে।

দেশে যদি সত্যিকার অর্থে গণপরিবহন বলে কিছু থাকত, তাহলে বেসরকারি বাস-মালিকরা এই নৈরাজ্যকর অবস্থা তৈরি করতে পারতেন না। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠতেও এই চক্র প্রবল বিরোধিতা করে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বিআরটিসি) বাস চলাচলেও চরম অসহযোগিতা করে পরিবহন খাতে একচেটিয়া প্রাধান্য বজায় রাখছে বেসরকারি পরিবহন ব্যবসায়ীরা। এর ফলে যাত্রী ভোগান্তির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।

অন্যদিকে বিআরটিসি নিজেও যেন ধুঁকে ধুঁকে মরছে। রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি চরম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে ক্রমাগত লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। একটি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় বেসরকারি পরিবহন মালিকরা ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিআরটিসিকে সচল করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কাজটি যে অতটা সহজ নয়, তা তো এর আগের ঘটনাপ্রবাহ থেকেই পরিষ্কার। বিআরটিসিকে কোণঠাসা করতে বেসরকারি পরিবহন- মালিকরা এককাট্টা। তারা জনপ্রিয় এ সার্ভিস বন্ধে নানা ধরনের তাণ্ডব চালায়। এমনকি ধর্মঘট ডেকে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে। অবশেষে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়।

অথচ ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশ বলে রাষ্ট্রীয় পরিবহন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিআরটিসির বাস দেশের যে কোনো স্থানে চলাচলের অধিকার রাখে। সরকার দেশে স্বল্পমূল্যে দ্রুত, দক্ষ, আরামপ্রদ, আধুনিক ও নিরাপদ সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে আশির দশকে বিআরটিসি বাস সেবা চালু করে। কিন্তু এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির পেছনে নানা কুচক্রী মহলের দৃষ্টি পড়ে। ২০০৪ সালে তৎকালীন জোট সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী বেসরকারি পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে এক চুক্তি করেন। পরবর্তী সময়ে এ চুক্তির দোহাই দিয়ে পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন রুট থেকে বিআরটিসির বাস উঠিয়ে দেওয়া হয়।

রাজধানীতেও বিআরটিসির পরিবহন সেবা ক্রমে ক্রমে সীমিত হয়ে আসছে। যদিও প্রতিটি সরকার এসেই নতুন করে বিআরটিসিকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করে। বর্তমান সরকারও বেশ কয়েক দফা বিআরটিসির নতুন বাস রোডে নামায়। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই অজানা কারণে বাসগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। দোতলা ভলভো বাসে সামান্য ত্রুটি দেখা দিলেই তা মেরামত না করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাস মেরামতের চেয়ে নতুন বাস কেনার দিকেই আগ্রহ বেশি বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের। এতে টুপাইস কামানো যায়। তাছাড়া গণহারে লিজ দেওয়ার ফলেও বিআরটিসিতে চলছে যাচ্ছে তাই কারবার।

রাজধানীতে প্রায় ২২ হাজার ছোট-বড় বাস চলে। এ সবের মালিক মাত্র ২ হাজার জন। দেখা যাচ্ছে অল্প কিছু মানুষ রাজধানীর সামগ্রিক পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে। এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে হলে বিআরটিসিকে সচল করার কোনো বিকল্প নেই। সারা দেশে বিআরটিসির বাস চলতে দিতে হবে প্রয়োজনীয় সংখ্যায়। বিশেষ করে রাজধানীতে বাসের সংখ্যা বাড়ানো একান্ত অপরিহার্য। সরকারকে মনে রাখতে হবে, মুষ্টিমেয় লোকের দুর্নীতি, লোভ ও লাভের কারণে গণপরিবহনের নৈরাজ্য আমাদের নিয়তি হতে পারে না।

গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা এবং যানজট দূর করে স্থবির ঢাকাকে বদলে না দিতে পারলে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সরকারগুলো গণপরিবহন খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়নি। তাই অন্তর্র্ব্তী সরকারের কাছে এ বিষয়ে নাগরিক প্রত্যাশা অত্যন্ত জোরালো। তারা চাইলে পরিবহন খাতে সংস্কার এনে আমূল পালটে দেওয়া সম্ভব।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close