
ঐকমত্যের নতুন অধ্যায় জুলাই ঘোষণাপত্র

জাতীয় ঐক্যের মূলে থাকা শক্তি যেকোনো জাতির অগ্রগতির প্রধান চালিকা শক্তি, তা ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে জুলাই ঘোষণাপত্রের দিকে জাতীয় ও রাজনৈতিক দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়া সেই ঐক্যের প্রত্যাশারই প্রকাশ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার উদ্যোগ এবং সর্বদলীয় বৈঠক একটি মাইলফলক। এটি জাতির ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে, যদি তা সঠিকভাবে পরিচালিত হয়।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের উত্থান হয়েছিল, যা আমাদের জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ড. ইউনূস নিজেই বলেছেন, এ সরকারের জন্ম ঐক্যের মাধ্যমে এবং ঐক্যই তার মূল শক্তি। এটি শুধু কথার কথা নয়, বরং জাতির জন্য একটি সুদূরপ্রসারী বার্তা। ইতিহাসে দেখা গেছে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল আনতে পারে। এ ক্ষেত্রে জুলাই ঘোষণাপত্র সেই ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে, যা জাতীয় উন্নয়ন ও সুশাসনের পথ সুগম করবে।
জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায় ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিলের অভিপ্রায় এবং গণঅভ্যুত্থানের আদর্শ বাস্তবায়নের সংকল্প তুলে ধরা হয়েছে। এটি যেমন অতীতের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়, তেমনি ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তাব করে। এটি শুধু একটি ঘোষণাপত্র নয়; বরং একটি জাতির আত্মমর্যাদার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান। তবে এ উদ্যোগের কার্যকারিতা নির্ভর করবে এর অন্তর্নিহিত অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়ার ওপর। সর্বদলীয় বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণসংহতি আন্দোলন এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের অংশগ্রহণ ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, বিভিন্ন মতাদর্শিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও জাতি একত্রিত হতে পারে। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এটি নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছে।
জুলাই ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি রোধ এবং নতুন জনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা একটি শক্তিশালী বার্তা বহন করে। তবে এ ঘোষণাপত্রে যে আদর্শ ও প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হবে কার্যকর পদক্ষেপ ও সময়োপযোগী নীতি। জুলাই ঘোষণাপত্রের সফল বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করতে পারে। জাতি হিসেবে আমাদের ঐক্যের শক্তি বিশ্বকে জানানো জরুরি। এ ঘোষণাপত্র যদি সব পক্ষের সম্মতিক্রমে প্রণীত হয়, তবে এটি শুধু বর্তমান সংকট সমাধানের পথই দেখাবে না, বরং ভবিষ্যতে জাতীয় ঐক্যের একটি মডেল হয়ে থাকবে। অবশ্যই, ঘোষণাপত্র প্রণয়নে সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ রাখতে হবে। জনগণের প্রত্যাশা, বিশেষত তরুণ সমাজের চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দিতে হবে। জাতীয় ঐক্যের এ উদ্যোগ কোনো একক দলের স্বার্থে সীমাবদ্ধ থাকলে তা ব্যর্থ হবে। জুলাই ঘোষণাপত্র শুধু একটি নথি নয়; এটি হতে পারে জাতির নতুন অধ্যায় রচনার সূচনা। এটি হবে এমন একটি দলিল, যা আমাদের অতীতের সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেবে। ঐকমত্য এবং দায়িত্বশীল নেতৃত্বের মাধ্যমে এটি হতে পারে দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির ভিত্তি। আমাদের প্রত্যাশা, এ ঐতিহাসিক পদক্ষেপ জাতিকে একটি ন্যায্য, সমৃদ্ধ এবং সাম্যভিত্তিক ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এ ঘোষণাপত্রের মাধ্যমেই জাতি তার অতীতের বিভাজন ও সংকটকে পেছনে ফেলে একটি সুনির্দিষ্ট পথে এগিয়ে যাবে। দেশের তরুণ প্রজন্মকে এ উদ্যোগের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে এটি বাস্তবায়নের জন্য সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। তাদের স্বপ্ন এবং প্রত্যাশাই আমাদের নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।
"