খন্দকার আপন হোসাইন

  ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫

আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ

রাষ্ট্রক্ষমতায় ভ্লাদিমির পুতিনের রজতজয়ন্তী

ভ্লাদিমির পুতিনের প্রকৃত নাম ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন। ১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর ভ্লাদিমির পুতিনের জন্ম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাত বছর পর জন্ম হলেও বিশ্বের বৈশ্বয়িক পরিস্থিতি তখনো স্বাভাবিক হয়নি। পৃথিবীতে আবির্ভাবের আগেই বড় ভাই নিহত হন। অবরুদ্ধ লেলিনগ্রাদের সেই ভয়াবহ সময়ে একরকম ভাগ্যক্রমেই বেঁচে যায় পুতিনের মা-বাবা। পুতিনের শৈশব, কৈশোরের প্রায় পুরো সময়টিই কেটেছে লেলিনগ্রাদে। লেলিনগ্রাদের পূর্বনাম ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গ। শহরটির প্রতিষ্ঠাতা জার পিটার দ্য গ্রেট। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরটি লেনিনগ্রাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে রুশ সাম্রাজ্যের গর্বিত অতীত ইতিহাসের ব্যাপক নিদর্শন ছিল শহরটিতে। ছিল স্থাপত্য ও সংস্কৃতিতে পশ্চিমা প্রভাবের সুস্পষ্ট ছাপ।

জীর্ণশীর্ণ জনাকীর্ণ একটি বাড়িতে একাধিক পরিবারের সঙ্গে যৌথভাবে বাস করতো পুতিনের পরিবার। সেখানেই বেড়ে উঠেছিলেন পুতিন। সেখানে একাধিক পরিবারের জন্য ছিল একটিমাত্র বাথরুম ও রান্নাঘর। নিত্যসঙ্গী ছিল বড় বড় ইঁদুর ও আরশোলা। ছোটবেলায় সিঁড়িতে, উঠোনে, ঘরের কোণে ইঁদুরের সঙ্গে লড়াই করতে হতো তাকে। স্মৃতিবিজড়িত সেইসব দিনের বিস্তারিত জানা যায় মাশা গেসেনের ‘দ্যা ম্যান উইদাউট আ ফেইস : দ্যা আনলাইকলি রাইস অফ ভ্লাদিমির পুতিন’ নামক গ্রন্থ থেকে। সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশচেভের নাতনি অধ্যাপক নিনা ক্রুশচেভার মতে, পুতিনকে কোণঠাসা করা সেইসব ইঁদুরের উপাখ্যানের সুর সময়ের উপর নির্ভর করে কমবেশি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ২০২৩ সালে বিবিসির এক অনুষ্ঠানে নিনা ক্রুশচেভারের দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় পুতিন কীভাবে একটি ছোট প্রাণী থেকে শুরু করে অনেক বড় বড় শত্রুর সঙ্গে লড়াই করে করে এই জায়গায় পৌঁছেছেন এবং এখনো কীভাবে দেশি-বিদেশি সব ধরনের শত্রুর মোকাবিলা করে চলছেন।

একটানা পঁচিশ বছর ধরে রাশিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ভ্লাদিমির পুতিন। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিনের পর ভ্লাদিমির পুতিনই একমাত্র শাসক যিনি এত লম্বা সময় ধরে রাশিয়ার মসনদে বসে আছেন। রাশিয়ার জনমনে পুতিনের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণ কী? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের গবেষণায় এসেছে পুতিনের একটিই মূলনীতি। তা হলো লড়াই অনিবার্য হলে প্রথমেই আঘাত হানা। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার ঘোষণা দেন। তার সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত দেশি বিদেশি সব প্রচার মাধ্যমে সম্প্রচারিত হয়েছিল। নতুন রাজনীতিবিদ, নতুন মুখ, নতুন চিন্তা আর বুদ্ধিদীপ্ত, প্রাণচঞ্চল ও শক্তিশালী নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে পুরো রাশিয়ার রাজনীতিকেই ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন বরিস ইয়েলৎসিন।

বরিস ইয়েলৎসিনের এরকম ঘোষণা দেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না। কেননা তার শাসনামলের শেষভাগে এসে রাশিয়ায় দুর্নীতি, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা চরম আকারে পৌঁছেছিল। তার শাসনকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল দেশবাসী। গোটা দেশ অনিশ্চয়তার পথে হাঁটছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ইয়েলৎসিন। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতিতে রাশিয়ার যাত্রা তার সময়ে জনগণকে দুঃসহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করেছিল। সেই সুযোগেরই উত্তম ব্যবহার করে বিংশ শতকের শেষ দিকে ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ভ্লাদিমির পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। ফলে পুতিন ছিলেন প্রায় সবার কাছেই রহস্যে ঘেরা মানুষ। আজও তাকে ঘিরে রহস্যের অন্ত নেই। ভ্লাদিমির পুতিনই রাশিয়ার একমাত্র নেতা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সোনালি অতীত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। পশ্চিমা বিশ্বের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে রাশিয়ার সীমানার সম্প্রসারণেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। সংগ্রামরত কৈশোর ও যৌবনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা পুতিন অলৌকিকেভাবে ক্রেমলিনের বাসিন্দা হন নাই।

ইয়েলৎসিনের পদত্যাগের ঘোষণার পর নতুন শতকের নতুন মুখ হিসেবে আবির্ভাব ঘটে ভ্লাদিমির পুতিনের। প্রথমবারের মতো টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন পুতিন। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পুর্ব সময় পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবেই দায়িত্ব পালন করেন। ক্ষমতার পালা বদল হলেও রুশ রাজনীতিতে শূন্যতা তৈরি হয়নি। সেই সময় ভ্লাদিমির পুতিন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে রাশিয়ার সংবিধান ও আইন পরিপন্থী সব প্রচেষ্টাকে কঠোরভাবে দমন করেন। বরিস ইয়েলৎসিনের শাসনামলে তাঁর দাম্ভিক আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল রুশ নাগরিক। তাই পুতিনের চৌকস কার্যক্রম ও সংযত কথাবার্তা অচিরেই মানুষকে আকৃষ্ট করতে শুরু করে। জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।

তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রের দুইটি মূল চরিত্র ছিল। সমাজতন্ত্র এবং বিশ্বশক্তি। নব্বইয়ের দশকেই সমাজতন্ত্রের উপর থেকে আস্থা উঠে গিয়েছিল রুশবাসীর। সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন কৌশল পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন করে যুগোপযোগী কৌশলগত রাজনীতি ফিরিয়ে এনেছিলেন পুতিন। সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির তুলনামূলক স্বল্প-পরিচিত এক পদ থেকে বাছাই করা হয়েছিল ভ্লাদিমির পুতিনকে। চেচনিয়ার স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়েই জনপ্রিয় হতে থাকেন পুতিন। ওই বছরের শেষ দিনে তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার সময়ে ইয়েলৎসিনের চেয়ে মানুষের আস্থা তার উপরই বেশি ছিল। ২০০০ সালের মার্চে পুতিনের অধীনে রাশিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে প্রায় ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পুতিন। দায়িত্ব নেওয়ার পর ভ্লাদিমির পুতিন চলনে, বলনে, কথনে, ভূষণে আরো দৃঢ়তার পরিচয় দিতে থাকেন।

গণতান্ত্রিক রাশিয়ায় পশ্চিমের মতোই পর পর দুই বারের বেশি প্রেসিডেন্ট হওয়া রীতি ছিল না। এজন্য ২০০৮ সালে ভ্লাদিমির পুতিন রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী হন। প্রেসিডেন্ট হন তারই ঘনিষ্ঠ দিমিত্রি মেদভেদেভ। সংবিধান মোতাবেক ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট পদে ফেরেন পুতিন। একে একে রাষ্ট্রের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের উপর তার রাজনৈতিক আধিপত্যের বিস্তার ঘটে। সংবিধান সংশোধন করা হয়। সব নির্বাচনেই অবাধে জালিয়াতি শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট পদের সময়সীমা তুলে দিয়ে ২০৩৬ পর্যন্ত বিস্তৃত করার চেষ্টা করা হয়। দেশের ভিতরে প্রশ্নহীন নেতৃত্ব স্থাপনের পর পুরোনো রুশ-সোভিয়েত প্রভাববৃত্তে হাত বাড়িয়েছেন একচ্ছত্র প্রেসিডেন্ট। গণতন্ত্রীকরণের তোড়ে হোচটও খেতে হয়েছে বহুবার। নিতে হয়েছে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত। যার একটি উদ্যোগ ক্রিমিয়ার সংযুক্তিকরণ। তাতে সফল হলেও সেখান থেকেই ইউক্রেনের সঙ্গে দীর্ঘ সংঘাতের সূচনা। ইউক্রেন সংঘাতের কারণে পুরো ইউরোপজুড়ে রুশ পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা চলছে।

বিবিসির রাশিয়াবিষয়ক সম্পাদক স্টিভ রোজেনবার্গের একটি লেখায় এসেছে ক্রেমলিন ত্যাগের সময় পুতিনকে একটি কথা বলেছিলেন ইয়েলৎসিন। উপদেশও বলা যায় ইয়েলৎসিনের সেই কথাকে। কথাটি ছিল ‘রাশিয়ার দিকে খেয়াল রাখবেন।’ বাস্তবে ইয়েলৎসিনের সেই কথা কি পুতিন রাখতে পেরেছেন? ভ্লাদিমির পুতিন দৃঢ়তার সঙ্গে বলে থাকে ‘আমি শুধু রাশিয়ার প্রতি খেয়াল রাখিনি বরং দেশটিকে নরকের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে এনেছি।’ যেসব বিষয় নিয়ে সোভিয়েত-সভ্যতার স্মরণ হয় তার সবই নানাবিধ কারণে বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় এসেই সোভিয়েত যুগের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনেন।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুতিন বরাবরই কঠোর। পুতিনের ভাষায় আইনভঙ্গকারীরা হল ‘ধেড়ে ইঁদুর। যাদের দমন করা উচিত।’ ২০০১ সালে পুতিনের জুডো প্রশিক্ষক আনাতোলি রাখলিন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেছিলেন, পুতিন ছিল আমার সেরা ছাত্রদের একজন। ওর মধ্যে অলিম্পিক টিমে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। জুডোর লড়াইয়ে সবসময়েই জেতার সংকল্প ছিল। যদি গায়ের জোরে না হয়- তাহলে বুদ্ধির কৌশলে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করত। জুডোর দ্বৈরথে সে প্রথমেই ডানে ও বাঁয়ে দুদিক থেকে আক্রমণ করতে চাইছে এমন দক্ষতার সঙ্গে অঙ্গভঙ্গি করত। প্রতিপক্ষ যখনই ভেবে বসত, ডান দিক দিয়ে

আক্রমণ আসবে, তখনই সে আচমকা বাঁ দিক দিয়ে আক্রমণ করত। পুতিন সবসময়েই প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দিতে চাইত। ছোটবেলা থেকেই কেজিবির এজেন্ট হওয়ার আকাঙাক্ষা ছিল পুতিনের।

পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরে তার মতো নিভৃতে কাজ করতে চাওয়া ব্যক্তির জন্য এই পেশাই ছিল উপযুক্ত। পুতিন নিজেও বলেছেন, কীভাবে ১৯৬৮ সালের সোভিয়েত গুপ্তচরবৃত্তির এক সিনেমা তার মনে কেজিবি এজেন্ট হওয়ার স্বপ্ন বুনে দিয়েছিল। ‘দ্য শিল্ড অ্যান্ড দ্য সোর্ড’ নামে ওই চলচ্চিত্রের মূল কাহিনি আবর্তিত হয় নাৎসি জার্মানিতে কর্মরত এক সোভিয়েত ডাবল এজেন্টের চরিত্রকে কেন্দ্র করে। যিনি নাৎসিদের গোপন দলিলের তথ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে তুলে দিতেন। গোয়েন্দা অফিসার হওয়ার ছোটবেলার সেই স্বপ্ন কখনো ভোলেননি পুতিন। ১৯৯৯ সাল থেকে পুতিন ধারাবাহিকভাবে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনা করছেন। ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে, ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবং ২০১২ সাল থেকে অদ্যাবধি রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতাসীন। বিশ্ববাসী ভ্লাদিমির পুতিনের একটানা রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকার রজতজয়ন্তী প্রত্যক্ষ করলো। মেধা, প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় কৌশলগত দূরদর্শিতা দিয়ে রহস্যাবৃত ভ্লাদিমির পুতিন গোটা পৃথিবীকে তার একটানা রাষ্ট্র পরিচালনার সুবর্ণজয়ন্তীও দেখতে বাধ্য করবে বলে মনে হচ্ছে।

লেখক : গবেষক ও সংগঠক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close