আর কে চৌধুরী

  ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫

মুক্তমত

সড়কে এত মৃত্যু দুর্ভাগ্য আমাদের!

সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ বছরের মধ্যে দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালে। প্রাণহানি প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষের। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ মর্মান্তিক তথ্য উঠে এসেছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে চব্বিশে সড়কে প্রাণ গেছে ৭ হাজার ২৯৪ জনের। যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যে প্রাণহানি সাড়ে ৮ হাজারেরও বেশি।

দুর্ভাগ্য আমাদের! ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্র্বর্তী সরকারের পাঁচ মাস পার হলেও, সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। অথচ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এটা প্রত্যাশা ছিল সব মহলের। নিরাপদ সড়ক দাবিতে ২০১৮ সালে সারা দেশে নাড়া দেওয়া এক ছাত্র-আন্দোলন হয়েছিল। তখন সরকার আইন প্রণয়নসহ নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরে যথারীতি সেসব পূরণ হয়নি, সড়কে শৃঙ্খলাও ফেরেনি। দুর্ঘটনা, প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি কিছুই কমেনি; বরং বেড়েছে। জুলাই বিপ্লবের পর পুলিশের অনুপস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা কিছুদিন সড়ক নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকা পালন করে। তখন বরং পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো ছিল। জনসাধারণ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে সম্মান, সহযোগিতা ও মান্য করেছে। এখন আবার বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। এতে পেশাদার ট্রাফিক পুলিশের সদিচ্ছা, সক্রিয়তা এবং সক্ষমতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন জাগছে। মানুষ হতাশ হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যাশিত নিরাপদ সড়কের জন্য দেশের সব সড়ক-মহাসড়ক থেকে ফিটনেসবিহীন যানবাহন তুলে নেওয়া, গতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর মনিটরিং এবং কম গতির অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করা জরুরি। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অবকাঠামো উন্নয়ন, ট্রাফিক আইন মেনে চলা এবং চালক-যাত্রী-পথচারী, অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের শতভাগ সচেতনতা।

সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য যে বেশি, তা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই। ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হই, কানে হেডফোন লাগিয়ে চলি, মাদকসেবন করে গাড়ি চালাই, বেপরোয়া গতিতে চলি। দুর্ঘটনা ডেকে আনি নিজেরাই। অনেক নামি পরিবহনেও চালকরা দূরপাল্লার গাড়ি চালান প্রয়োজনীয় বিরতি-বিশ্রাম ছাড়াই। এদের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের। সেখানেও তদারকি থাকতে হবে। সবার কার্যকর সচেতনতায় দেশের সড়ক নিরাপদ হোক। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটা নিশ্চিত করবেন। এটা তাদের পেশাগত দায়িত্ব। ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহির দায়ও তাদেরই।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সারা দেশে ৮৬.৩৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ চালকের বেপরোয়া গতি। এ ছাড়া ভুল ওভারটেকিংয়ের কারণে ঘটে ৪.৩৬ শতাংশ দুর্ঘটনা। সব মিলে সড়ক দুর্ঘটনার ৯০.৬৯ শতাংশের জন্যই দায়ী চালক। সড়কে দুর্ঘটনা হ্রাসে ইতঃপূর্বে পেশাদার চালকদের লাইসেন্স পেতে ও নবায়নের ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা ছাড়াও পর্যাপ্ত বিশ্রামের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল।

দুঃখজনক হলো, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কমপক্ষে ১১১টি সুপারিশ করা হলেও আজ পর্যন্ত এর অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা মনে করি, যেভাবেই হোক সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সচেতন হতে হবে পথচারীদেরও। একইসঙ্গে আইনের যথাযথ প্রয়োগ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চালক এবং সড়কে চলাচল উপযোগী ভালো মানের যানবাহন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এসবের পাশাপাশি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে পুলিশ কর্তৃক চার্জশিট দাখিল এবং দ্রুত ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম করা হলে তা সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরসাইকেল ক্রয় ও চালনার ক্ষেত্রে ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ ও মনিটরিং নিশ্চিত করা না গেলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার চিত্র আরো ভয়াবহ হবে। সড়কে মাত্রাতিরিক্তভাবে মোটরসাইকেলের প্রবেশ ঘটেছে এবং তাদের বেপরোয়া চলাচলও দুর্ঘটনার শঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলেছে। পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে, কোনো যানবাহনই আইন মান্য করে চলছে না। সবার মাঝে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর প্রবণতা যেন একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এ ব্যাধি আরো সংক্রমিত হবে। দুর্ঘটনা বাড়বে। বাড়বে মৃত্যু। সড়কে মৃত্যু ও নৈরাজ্যকর অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সমস্যাটিকে সবার আগে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পাশাপাশি পরিবহণ মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সমন্বিত কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হবেন, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close