মোতাহার হোসেন
দৃষ্টিপাত
মানুষের কষ্ট লাঘবে করণীয়

দেশের সাধারণ মানুষ বহুবিধ কারণে কষ্টে আছে, বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এর মধ্যে সংকোচিত কর্মসংস্থান, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ক্রমাগত মূল্যস্ফীতি, আইনশৃঙ্খলার বৈরি অবস্থায় দেশের নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তরা বহুবিধ সংকটে পতিত। অবশ্য জনসমস্যা লাঘব করতে নোবেল বিজীয় অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারও নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোপূর্বে দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মরধ্য রাখতে ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, চালসহ কয়েকটি পণ্য আমদানি পর্যায়ে শুল্কহার হ্রাস, টিসিবি, বিএডিসি, খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে কম মূল্যে শাকসবজি, ডিম, ভোজ্যতেল, মসুরের ডাল, চাল-আটা বিক্রি করেছে। কিন্তু সেই সব উদ্যোগও এখন নেই।
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য গত অক্টোবর মাসে ট্রাকে করে তেল, ডাল ও চাল বিক্রির কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। ফলে টিসিবির পরিবার কার্ড না থাকলেও প্রতিদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামে সাড়ে ২৪ হাজার মানুষ ভর্তুকিমূল্যে এসব পণ্য কেনার সুযোগ পেতেন। গত অক্টোবরে ট্রাকে করে ভর্তুকি মূল্যে কৃষিপণ্য বিক্রির কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এটিও সম্প্রতি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অনিয়মের অভিযোগে সারা দেশে টিসিবির এক কোটি পরিবার কার্ডের মধ্যে ৪৩ লাখ কার্ড বাতিল করা হয়েছে।
অন্যদিকে, জনগণকে স্বস্তি দিতে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তারল্যসংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে বাড়তি সাড়ে বাইশ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে সরবরাহ করা হয়েছে। একইভাবে মানুষকে নিরাপত্তা দিতে আইনশৃঙাখলা বাহিনীকে সর্বদা সর্তক পাহারায় মোতায়েন রাখার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অন্তর্বর্তী সরকারের এসব মহতী উদ্যোগের সুফল পাচ্ছেনা সাধারণ মানুষ। অর্থনীতিবিদদের মতে, টাকা যার কাছে যায় তার, বরং ওই টাকা জনগণের উপকারে আসে না। অনুরূপ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ অনেকটা নিরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের। তদুপরি বিগত জুলাই-আগষ্টে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে বেশিরভাগ পুলিশ খুনির ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় বিদ্যমান পুলিশের মনোবল ভেঙেছে এবং জনআস্থা তলানিতে থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনুকূলে আসছে না। চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখল, পিটিয়ে হত্যা, ডাকাতি, রাহাজানির ঘটনায় অস্বস্থিতে আছে মানুষ। মূলত এসব কারণেই মানুষের মধ্যে হতাশা, দুঃখবোধ এবং কষ্ট আছে। আছে এ সব নিয়ে মানুষের মধ্যে সরকারকে নিয়ে সমালোচনাও।
এরই মধ্যে সম্প্রতি ১০০টি পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি উসকে দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদেরা। একইভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যেও দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। তবে ভ্যাট বাড়ানোয় সাধারণ মানুষের ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে না বলে দাবি করছে অর্থ উপদেষ্টা এবং জাতীয় রাজস্ব। এ ক্ষেত্রে সরকারি মহল মানুষের কষ্টের কথা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা ভাবেনি বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের। কারণ এমনিতে ক্রমাগত পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে যখন হাঁসফাঁস অবস্তা, ঠিক এমনি অবস্থায় ১০০টি সেবা ও পণ্যের ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আরোপের ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় আরো একদফা বাড়তে পারে এমন আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। তাছাড়া এর আগে যে কয়েক দফায় ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, পেঁয়াজ, চালে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছিল বাস্তবে তার প্রভাব পড়েনি বাজারে। বরং শুল্ক ছাড়ের টাকায় আমদানি কারক ও ব্যবসায়ীর চক্রের পকেটে যায়।
এ পর্যায়ে সম্প্রতি ১০০ পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট আরোপ করায় সেই সব সেবা পণ্যের দাম বাড়বে। যেসব পণ্যে ভ্যাট আরেপট করা হয়েছে এই তালিকায় রয়েছে- জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়া দুধ, বিস্কুুট, জুস, ফলমূল, পোশাক, টিসুপেপার, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার, রেস্তোরাঁর খাবার, বিমানের টিকিট ইত্যাদি। স্বভাবতই ভ্যাটহার বাড়ানোর ফলে এসব পণ্য ও সেবার দাম আরো বাড়বে। ফলে তা সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্তের ওপর ‘মড়ার ওপর খাড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দেবে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভ্যাট হার বাড়াতে চায়নি। মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করতেই ভ্যাট বাড়ানোর এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। উপদেষ্টা পরিষদ নতুন ভ্যাট হারের বিষয়টিতে অনুমোদনও দিয়েছে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি ঋণের শর্ত হিসাবে আইএমএফ ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছে।
বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারে চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে আইএমএফের একটি মিশন। চলমান এই ঋণ কর্মসূচির আকার আরো ৭৫ কোটি বাড়ানোর অনুরোধ জানায় বাংলাদেশ। এ অর্থ দিতেও সম্মত হয়েছে আইএমএফ; তবে এজন্য রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর মতো কিছু কঠোর শর্ত দেয় আইএমএফ। ঋণ দিতে আইএমএফ বাংলাদেশকে কর-জিডিপির অনুপাত ০.২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে, টাকার অঙ্কে যা ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ টাকা চলতি অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে যোগ হবে। এ কারণেই বাড়ানো হয়েছে ভ্যাটহার।
মূলত অর্থনীতির বাস্তবতায় সরকারের ওপর দায়দেনার চাপ বাড়ছে। সরকারের অর্থ দরকার। তাই বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টিও পুনর্বিবেচনা করা উচিত। এমনিতে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম বেড়েই চলেছে, অথচ মানুষের আয় সেভাবে বাড়ছে না। বহু মানুষ প্রয়োজনীয় পণ্য খুব বেশি দরকার না হলে ব্যবহার কমাচ্ছে এবং একইসঙ্গে অন্যান্য ব্যয় কমাতে বাধ্য হচ্ছে। খাবারের খরচ কমানোর ফলে বাড়ছে পুষ্টিহীনতা। এর প্রভাবে মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে শনিবার (৪ জানুয়ারি) ‘ভ্যাট এবং আয়করের আওতা বৃদ্ধি ও হার যৌক্তিকীকরণ’ শীর্ষক এক বিজ্ঞপ্তিতে এমন দাবি করেছে এনবিআর। এনবিআর বলছে, যেসব পণ্য ও সেবায় ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করা হচ্ছে, এর মধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য নেই। বিধায়, সর্বসাধারণের ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে না এবং মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে না।
জনস্বার্থে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির শুল্ক, করহারে ব্যাপক ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি, এসডিজি বাস্তবায়ন, এবং জাতি হিসেবে স্বাবলম্বী হওয়ার লক্ষ্যে ভ্যাটের আওতা বৃদ্ধি ও হার যৌক্তিকীকরণের লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাটের আওতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক এবং আবগারি শুল্কের হার ও পরিমাণ যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যবর্তী সময়ে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে বলে জানায় এনবিআর।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত চার মাসে বাজারে নিত্যপণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি ও মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে চাল, আলু, পেঁয়াজ, চিনি, ডিম, খেজুর, ভোজ্যতেল, ও কীটনাশকসহ আটটি পণ্যে আমদানি, স্থানীয় ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে জনস্বার্থে শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর ছাড় দেওয়া হয়। এতে রাজস্ব আদায় ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ছাড়া অন্যান্য খাত থেকে রাজস্ব বৃদ্ধি করা না গেলে বিপুল পরিমাণ বাজেট ঘাটতি দেখা দেবে। এ কারণে মূল্য সংযোজন করের পাশাপাশি আয়করের ক্ষেত্রেও করের আওতা বাড়ানোর নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আয়কর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার ধারাবাহিকতায় আয়কর অব্যাহতির বিধান বাতিল ও সংশোধনের কার্যক্রমও প্রক্রিয়াধীন। এর আগে এনবিআর জানিয়েছিল, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাকি ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) অতিরিক্ত ১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মূলত এ লক্ষ্যে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও পোশাকের ওপর ভ্যাটের হার বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে এনবিআর। বর্তমানে সাধারণ মানের এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) রেস্তোরাঁয় খাওয়ার জন্য ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এটি বেড়ে সাড়ে ৭ শতাংশ হতে পারে। এ ছাড়া, নন-এসি হোটেলের ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ করে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আর স্থানীয় ব্র্যান্ডের পোশাকের ওপর বর্তমানে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। এটিও দ্বিগুণ হতে পারে। বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে জনজীবনে অনেক দুর্ভোগ নেমে এসেছে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে বর্তমান বাজারব্যবস্থার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলছেন। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর কমে না। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে কাজ করলেও, তা কার্যকর ভূমিকা না রাখায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না। তাই প্রত্যাশা থাকবে সাধারণ মানুষকে স্বস্থি দিতে পুরো মাত্রায় টিসিবি, ওএমএস, পারিবারিক রেশনব্যবস্থার পাশাপাশি বাজারে নিত্যপেণ্যর সরবরাহ, দাম নিয়ন্ত্রণে তদারকি প্রয়োজন।
লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক- বাংলাদেশ ক্লাইমেট জার্নালিস্ট ফোরাম।
"