অলোক আচার্য
আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ
জাস্টিন ট্রুডো; জনপ্রিয়তার শীর্ষ থেকে মাটিতে

রাজনীতিতে উত্থান পতন আছে। রাজনীতিতে সফলতা ব্যর্থতা আছে। আজ হয়ত যাকে তুমুল জনপ্রিয় ভাবছি কালও যে সে ঠিক সেরকম জনপ্রিয় থাকবেন এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। বছরের শুরুতেই কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর পদত্যাগ বিশ্ব রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কয়েক সপ্তাহ আগে অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড পদত্যাগ করেন। ট্রুডো তাকে কম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ নিতে বলার পর তিনি পদত্যাগ করেন। ফ্রিল্যান্ড প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনের সময় কানাডার প্রধান বাণিজ্য আলোচক ছিলেন। ট্রুডোর অন্যতম বিশ্বস্ত সহযোগীও ছিলেন তিনি। তবে বাজেট এবং সম্ভাব্য মার্কিন শুল্ক নিয়ে মতবিরোধ তার পদত্যাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জাস্টিন ট্রুডো একজন ফ্রেশ রাজনীতিবিদ হিসেবেই পরিচিত। বিশ্বে জনপ্রিয় রাজনীতিকদের তালিকা তৈরি হলে কয়েকজনের ভেতর জাস্টিন ট্রুডোর নাম উঠে এসেছে। মাত্র কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এক দশক আগে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন। নিজের দলের হাল যখন ধরেন তখনো তিনি দলের ভেতরে ব্যাপক জনপ্রিয় নেতা। কিন্তু সম্প্রতি একের পর এক ঘটনায় ট্রুডোর জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। এবং এসবের জেরে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন। মেয়াদ শেষ না করে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। অবস্থার দৃষ্টিকোণ বিচারে এটাই ট্রুডোর জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত এবং নিজের জন্য ভালো সময় অবশিষ্ট রয়েছে। কানাডার লিবারেল পার্টির নেতা হিসেবে ২০১৫ সালে জাস্টিন ট্রুডো দেশটির ২৩তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। অবশ্য ট্রুডোর রাজনীতির ইতিহাস আরো অনেক বছর আগের। তরুণ বয়স থেকেই তিনি ছিলেন লিবারেল দলের সমর্থক। বাবার মৃত্যুর পর ২০০০ সাল থেকে ট্রুডো লিবারেল পার্টিতে আরো বেশি জড়িয়ে পড়েন। ২০০৭ সালে লিবারেল পার্টির নেতৃত্ব মনোনয়ন পান। ২০০৮ সালের ফেডারেল ইলেকশনে তিনি হাউস অব কমন্সে নির্বাচিত হয়ে লিবারেল পার্টির যুব ও সংস্কৃতি বিভাগের একজন সমালোচক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। পরবর্তী বছর তিনি নাগরিক ও ইমিগ্রেশন বিভাগের সমালোচকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালে সেকেন্ডারি শিক্ষা এবং যুব ও শৌখিন খেলাধুলা বিভাগের সমালোচকের দায়িত্ব পান। ২০১৩ সালের এপ্রিলে ট্রুডো লিবারেল পার্টির নেতৃত্ব পান। ২০১৫ সালে তার নেতৃত্বে ১৮৪ এর মধ্যে ৩৬টি আসন পেয়ে কানাডার ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন নিয়ে লিবারেল পার্টি সরকার গঠন করে।
বাবার হাত ধরেই তিনিও আসেন কানাডার ক্ষমতায়। দীর্ঘসময় ধরে কানাডার হাল ধরে থাকেন। জো ক্লার্কের পর তিনি কানাডার দ্বিতীয় কমবয়সী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন থেকে বেশ ভালোভাবেই সামলেছেন দায়িত্ব। খুব বেশি সমালোচনা হয়নি কানাডা অথবা ট্রুডোকে নিয়ে। তবে কিছু বিষয় তার সমালোচানা সৃষ্টি করেছে। ভারতের সঙ্গে কানাডার সুসম্পর্ক বরাবরই ছিল। কিন্তু এই অবস্থার চূড়ান্ত অবনতি ঘটে গত বছর। খালিস্থানপন্থি শিখ নেতা হরদিপ সিং নিজ্জর হত্যাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্ক টানাপোড়েন শুরু হয়। সেই ঘটনা বহুদূর গড়ায়। এবং খুব বেশি অগ্রগতিও হয়নি। আলোচনায় এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কানাডা নিয়ে মন্তব্যও। এনডিটিভির খবরে জানা যায়, পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টা পরেই কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যের বানানো ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটি নতুন নয়। এর আগেও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। এ নিয়েও তোপের মুখে পরেন ট্রুডো সরকার। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প ঘোষণা দেন ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিনেই তিনি কানাডা থেকে আমদানিকৃত সব পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ কর আরোপ করবেন। ট্রাম্পের এমন হুঁশিয়ারি বার্তার পর গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটে আসেন ট্রুডো। দেখা করেন ট্রাম্পের সঙ্গে। সেই সময়ও ট্রাম্প ট্রুডোকে বলেছিলেন যে কানাডা যেন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হয়। যদিও তখন বিষয়টিকে মজা হিসেবে এড়িয়ে গেছেন ট্রুডো। মজা হিসেবে বিষয়টিকে হালকা করার চেষ্টা করলেও মূলত এটা এতটা হালকা ছিল না।
নিজের দলেও তার অবস্থান ক্রমশই দুর্বল হতে থাকে। তবে এসব ট্রুডোর পদত্যাগের পিছনে যথেষ্ট কারণ নয়। রয়েছে আরো বেশ কিছু কারণ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, বিশ্লেষকরা অবশ্য নানা কারণ সামনে আনছেন। এমনকি ভারতের সঙ্গে ট্রুডোর এই দ্বন্দ্বও কেউ কেউ পদত্যাগের কারণ হিসেবে দাঁড় করাতে চাচ্ছেন। যদিও এটা অত্যন্ত দুর্বল কারণ। এর সঙ্গে পারিপার্শি¦ক কারণগুলো মেলালে অবশ্য ট্রুডোর চাপের কারণটা বোঝা যায়। ক্রমশই তিনি দল এবং জনগণ থেকে সরে যাচ্ছিলেন। কানাডার মানুষের জীবনেও মুদ্রাস্ফীতি প্রভাব বিস্তার করেছিল। জনগণের জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায় ব্যাপকহারে। এটাও ট্রুডোর জনপ্রিয়তাকে কমিয়ে আনে। এছাড়া জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় তার অবস্থান, ফেডারেল বাজেট প্রস্তাব নিয়ে সমালোচনা যা নিজের দলেও হয়েছিল এসব ক্রমেই তার সময়কে কমিয়ে আনতে ভূমিকা রেখেছিল। ২০২৪ সালের জুনে টরন্টোতে একটি বিশেষ নির্বাচনে লিবারেল পার্টি তাদের সবচেয়ে নিরাপদ একটি আসন হারায়। অক্টোবর মাসে লিবারেল পার্টির ২০ জনের বেশি আইনপ্রণেতা ট্রুডোকে চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী পদে না দাঁড়ানোর অনুরোধ করেন। আগামী অক্টোবর মাসে কানাডার সাধারণ নির্বাচন। এ সময় নিশ্চয় লিবারেল দল ট্রুডোর বিকল্প কাউকে মনোনীত করবে। কিন্তু ট্রুডোর দলের অবস্থা বস্তুত ভালো না। এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে যে ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে বিরোধী দল। সব জনমত সমীক্ষাতেই দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর জনপ্রিয়তা একবারে তলানিতে ঠেকেছে। মুদ্রাস্ফীতি থেকে বেকারত্ব, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, দেশের বাইরে থেকে আসা লোকেদের দাপটসহ নানা ইস্যুতে দলটি এখন অনেকটাই ব্যাকফুটে রয়েছে। সেখান থেকে দলকে টেনে তুলতে ট্রুডোকে সরতেই হতো। পাশাপাশি দলের চাপও ছিল। ঘরে বাইরে একসঙ্গে চাপ সামলানো ট্রুডোর জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর চেয়ে সরে দাঁড়িয়ে দলকে কিছুট সময় দেওয়া ঘুরে দাঁড়ানোর এবং নিজেকে কিছুটা ভারমুক্ত করে আবার শুরু করা এই দুইয়ের জন্য উত্তম হিসেবে পদত্যাগ করে সরে দাঁড়ানোই শ্রেয় মনে করেছেন তিনি। বলা যায় টুডোর হাত ধরেই উত্থান ঘটেছিল লিবারেল দলের। আবার তার হাত ধরেই ক্রমাগত জনপ্রিয়তা হারিয়েছে দলটি। এ যেন একই বৃত্তের দুই মেরু।
গত সোমবার কানাডীয়দের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জাস্টিন ট্রুডো জানান, দেশের গভর্নর জেনারেল তার পার্লামেন্ট প্ররোগড করার অনুরোধ গ্রহণ করেছেন। প্ররোগড পার্লামেন্ট মানে হলো সংসদ কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করা, যেখানে বিতর্ক ও ভোটসহ সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে, তবে সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে না। মতামত জরিপ অনুসারে, কনজারভেটিভ পার্টির নেতা পিয়েরে পলিয়েভ্রে কানাডার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। এক জরিপ বলছে, যদি আজই কানাডায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টি সহজেই জয়লাভ করবে। ২০২২ সালে কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণের পর থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর একজন কঠিন প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন এবং বারবার আগাম নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছেন। পলিয়েভ্রে নিজেকে ‘অ্যান্টি-এলিট’ এবং ‘অ্যান্টি-ট্রুডো’ হিসেবে উপস্থাপন করেন, যিনি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। এপ্রিল মাসে সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি ট্রুডোকে ‘উন্মাদ’ এবং ‘চরমপন্থি’ বলে আখ্যা দেন। পরবর্তীতে, এই বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাকে সংসদ থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। এখন আপাতত মনে হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে লিবারেল পার্টিকে বেশ লড়াই করতে হবে। ট্রুডোর কিছু ভুল সিদ্ধান্ত এবং পরিস্থিতি ক্রমশই বিপক্ষে চলে গেছে। ব্যক্তির চেয়ে দলের গুরুত্ব বেশি। আর ট্রুডো এই সময়ে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়ে দলকে নতুন নেতা খুঁজে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন যাতে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া যায়। তবে এখন কানাডার দায়িত্ব লিবারেল দলের উপরই থাকবে কিনা সেটাও নিশ্চিত না। তবে এখনো সেই দিকেই রয়েছে দেশ। আগে দেখতে হবে দলের দায়িত্বভার কার ওপর বর্তায়। এই দুঃসময়ে কে দলের ত্রাতা হয়ে আসেন। তারপর তো পরবর্তী চিন্তা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
"