উম্মে সালমা
মুক্তমত
অতিথি পাখি পরিবেশের বন্ধু, রক্ষা করা উচিত

পাখি প্রকৃতির সম্পদ। দেশের পাখি ছাড়াও অনেক পাখি এ দেশে অতিথি হয়ে আসে। আদর করে আমরা সেগুলোকে বলি ‘অতিথি পাখি’। বিচিত্র তাদের বাচ্চা পালন, বাসা তৈরির কৌশল। ঝড়, বৃষ্টি, তুষারপাতসহ প্রকৃতির প্রতিকূলতা থেকে বাঁচতে তারা পাড়ি জমায় হাজার হাজার মাইল দূরে।
পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি পাখি আসে বাংলাদেশে। শীতপ্রধান দেশের তুষারপাত থেকে বাঁচতে, অস্তিত্ব রক্ষার্থে খাবার ও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশের মতো কম শীতপ্রধান দেশে অতিথি পাখির আগমন ঘটে। আবার বসন্ত মানে মার্চ-এপ্রিলে শীতপ্রধান অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করে, গাছপালা জন্মায় কিছু কিছু। ঘুম ভাঙতে শুরু করে পুরো শীতকালে ঘুমিয়ে থাকা অনেক প্রাণীর। তখন এ অতিথি পাখিরা নিজ দেশে ফিরে যায়।
আদিকাল থেকেই পাখিদের আবির্ভাবের রেওয়াজ রয়েছে। জানা গেছে, পৃথিবীতে বর্তমানে জীবিত পাখি প্রজাতির সংখ্যা ৯ হাজার ৮০০ থেকে ১০ হাজার ৫০টি। এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার প্রজাতির পাখি অতিথি। এরা নিজ দেশের তীব্র শীত থেকে বাঁচতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আসা-যাওয়া করে থাকে।
ধারণা করা হয়, পাখিদের স্থানান্তর শুরু হয় এখন থেকে প্রায় ৫ কোটি বছর আগে। বিজ্ঞানীরা বলে, আরামদায়ক পরিবেশের আশায় নিয়মের কারণে দেশভ্রমণে বের হয়। প্রতি বছর শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্নস্থানে অতিথি পাখির আগমন ঘটে। বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক ভবনসংলগ্ন লেকসহ এখানকার বিভিন্ন লেকে ২০-২৫ প্রজাতির পাখি আসে। তবে সবচেয়ে বেশি আসে জাডানিক বা সরালি হাঁস। কালচে বড় লম্বা গলার সরালি পাখি দেখতে অনেকটা দেশি হাঁসের মতো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাড়া মিরপুর চিড়িয়াখানার লেক, বরিশালের দুর্গাসাগর, নীলফামারীর নীল সাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা আর সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর অতিথি পাখিদের প্রিয় অবকাশকেন্দ্র। এছাড়াও নদ-নদী, বিল-ঝিল, পুকুর-জলাশয় ধীরে ধীরে এখন অতিথি পাখির আগমনে মুখরিত হয়ে উঠছে। যেসব অতিথি পাখি শীতের সময় আমাদের দেশে আসে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বক, পানকৌড়ি, কবুতর, গিরিয়া, পাতারি ইত্যাদি।
আরো নানা রং আর কণ্ঠবৈচিত্র্যের পাখি, যেমন গোলাপি রাজহাঁস, বালি হাঁস, সরালি, পাতিহাঁস, বৈকাল, নীলশীর পিয়াং, চীনা, পান্তামুখী, রাঙামুড়ি, কালোহাঁস, রাজহাঁস, চখাচখি, গিরিয়া, খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগি, পাতিবাটান, কমনচিল, কটনচিল প্রভৃতি। শীত আর অতিথি পাখি যেন একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশে অতিথি পাখির বিচরণক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাইল হাওর, নিঝুম দ্বীপ, ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন জলাশয়, বিভিন্ন চর-দ্বীপ ইত্যাদি।
পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, একদশক আগেও এদেশে ২০০ থেকে ২১৫ প্রজাতির অতিথি পাখি আসত। এ সংখ্যা প্রতি বছরই হ্রাস পাচ্ছে। এর পেছনেও বিভিন্ন কারণ রয়েছে। অতিথি পাখির নিরাপদ জীবনযাপন ও পরিবেশ দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে। অনেকে শখ মেটাতে শীতে অতিথি পাখি শিকারে বের হন। অনেকে আবার এ শীতে পাখি শিকারকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। পাখি শিকারিরা গুলি করে, বিষটোপ ব্যবহার করে, জাল পেতে অতিথি পাখি হত্যা করে। আবার শীতকালে বাজারে সবার সামনে অতিথি পাখি বিক্রিও করতে দেখা যায়। পাখি শিকার করা মানে অমানবিকতার পরিচয় দেওয়া। যে পাখিরা শুধু জীবন ও খাদ্যের সন্ধানে আমাদের মতো দেশে আসে, নিজেদের অসচেতনতা ও লোভের বশবর্তী হয়ে কিছু লোক সেই অতিথি পাখিরই জীবন বিনষ্ট করছে বা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে। মানবিক মানুষের এমন অমানবিক আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়।
অতিথি পাখি প্রকৃতি বা পরিবেশের বন্ধু। অতিথি পাখি শুধু জলাশয়ের অপরূপ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না, আমাদের উপকারও করে। ফসলের জন্য ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে অতিথি পাখি কৃষককে সহায়তা করে। যে দেশে পাখি বেশি, সে দেশে পর্যটকের সংখ্যাও বেশি। জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগের ফলে পাখিরা মৃত কীটপতঙ্গ খেয়ে মারা যাচ্ছে। পরিবেশ উজাড় হয়ে যাচ্ছে, জলাশয়ের দূষণ বাড়ছে, ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ রক্ষা, মানুষের মানবিকতা ও সচেতনতাই অতিথি পাখির জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরির জন্য যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিটি দেশকেই অতিথি পাখির জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী, অতিথি পাখি হত্যার দায়ে অপরাধীকে এক বছরের কারাদণ্ড অথবা ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। এছাড়াও অতিথি পাখির মাংস, ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি কাজে জড়িত থাকলে তার জন্য শাস্তির যথাযথ বিধান রয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো- আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ নেই। অতিথি পাখি হত্যার সঙ্গে জড়িত অমানবিক মানুষগুলোর কিছুই হচ্ছে না। তাই পাখি শিকারিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন, কর্তৃপক্ষ ও সচেতন নাগরিককে অতিথি পাখি রক্ষায় অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, অতিথিসহ সব পাখি প্রকৃতির সম্পদ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশ পরিবর্তন হচ্ছে। তাই পাখি রক্ষার্থে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অতিথি পাখিরা আমাদের দেশে আসুক, ভরে উঠুক জলাশয়ের চারপাশ।
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ।
"