মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

  ১২ জানুয়ারি, ২০২৫

বিশ্লেষণ

পরিবেশে বাতাস এবং শব্দদূষণ রোধে সতর্কতা

ঢাকার বাতাস এবং শব্দের দূষণ সম্পর্কে ঢাকাবাসী কতটা সচেতন তা বোঝা মুশকিল। তবে শব্দের সহনশীল মাত্রার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ তীব্র শব্দ প্রতিনিয়ত ঢাকাবাসীর কর্ণকুহরে এসে আঘাত হানছে তা বোধকরি অনেকের জানা নেই। শব্দদূষণের প্রভাবে অজান্তেই ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে মানুষের শ্রবণশক্তিসহ শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আর নিশ্বাসের সঙ্গে দূষিত বাতাস গ্রহণ জীবনের জন্য ঝুঁকি বয়ে আনছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এবারের থার্টিফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ও পটকা ফোটানো থেমে থাকেনি। প্রতি বছর থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনের রাতে আতশবাজি, পটকা ফোটানোর শব্দে মানুষের কান ঝালাপালা হয়ে যায়। পোড়ানো হয় লাখ লাখ টাকার বাজি, ওড়ানো হয় ফানুস। অনেক সময় পটকা ফোটানোর ফলে আক্রান্ত হন পথচারী। কারো বাড়ির ছাদে পটকা বা আতশবাজির আগুন পড়ে আহত হন কেউ। একবারতো আতশবাজির আগুনে মানুষ দগ্ধ হওয়ার ঘটনাও ঘটে। পরে তা থানাপুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। শুধু তাই নয়, পটকা ও আতশবাজির ধোঁয়ায় বায়ুদূষণের মাত্রাও কম নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বিগত সাত বছরে রাজধানীতে উৎসবে আতশবাজি ফোটানো এবং ফানুস ওড়ানোর বায়ুদূষণ গড়ে ১৯ শতাংশ বেড়েছে। বিগত বছরগুলোতে রাজধানী ঢাকায় নতুন বছর উদযাপনের মাতামাতিতে বায়ুমান সুচকের অবনতি লক্ষ্য করা গেছে। এসময় ফানুস ওড়ানো এবং আতশবাজি ও পটকা ফোটানোর কারণে বাতাসে সুক্ষ ধূলিকণা এবং নানারকম গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। গত বছরের শুরুর রাতেও বায়ুদূষণের পরিমাণ ৬৪ মাইক্রোগ্রাম বেড়েছে। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের নববর্ষের রাত ১১-১২টার তুলনায় পরবর্তী এক ঘণ্টায় বায়ুদূষণের পরিমাণ প্রায় ৩৬ শতাংশ এবং শব্দদূষণ ১০২ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। আর ২০২৪ সালের নববর্ষের রাত ১১-১২টার তুলনায় পরবর্তী এক ঘণ্টায় বায়ুদূষণের পরিমাণ প্রায় ৩৫ শতাংশ এবং শব্দদূষণ ৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দূষণের এ ধরনের ক্ষতিকর প্রভাবে শুধু মানুষই নয়, আতশবাজি ও পটকার বিকট শব্দে পাখিরা বাসস্থান ছেড়ে দূরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কখনো দ্রুত উঠে যেতে ভবনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে হতাহত হয়ে থাকে।

ঘনবসতিপূর্ণ ও ব্যাপক যানজটের শহর ঢাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া যায় ১১৯ ডেসিবেল এবং এর পরেই রয়েছে রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবাসিক এলাকার জন্য অনুমোদনযোগ্য শব্দসীমার মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। এছাড়া বাণিজ্যিক এলাকা ও যেখানে যানজট রয়েছে সেখানে এ মাত্রা ৭০ ডেসিবেল। পরিবেশগত শব্দের উৎস হিসাবে রাস্তার যানজট, বিমান চলাচল, রেল চলাচল, যন্ত্রপতি, শিল্প ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ধরনের শব্দ শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে উল্লেখ করা হয়। অন্য এক গবেষণামতে, ঢাকার অনেক জায়গায় শব্দমাত্রা ১০৭ ডেসিবল পর্যন্ত উঠে যায়। অথচ ১০০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দেই একজন মানুষ চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে। এরপরে রযেছে বাতাসের দূষণ যা দেশের সর্বাধিক আলোচিত একটি বিষয়। বায়ুদূষণে রাজধানী ঢাকা অনেক সময়ই বিশ্বে শীর্ষে চলে আসে। বিশেষ করে শীতকালে এ মাত্রা সাধারণত অধিক হতে দেখা যায়। যানবাহনের ধোঁয়া, ইটভাটা, এখানে-সেখানে রেখে দেওয়া নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ থেকে বায়ুদূষণ বেশি ঘটে। বায়ুদূষণের ফলে মানুষ শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস এমনকি ফুসফুসের ক্যানসারে পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বায়ুদূষণের কারণে বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্কদের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বায়ুদূষণের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব জনস্বাস্থ্যে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

আইনানুসারে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এসব জায়গায় গাড়ির হর্ন বাজানো বা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের আটটি বিভাগে গাড়ির হর্নকেই প্রধান শব্দদূষণের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। সুস্থ ও স্বাভাবিক শ্রবণক্রিয়ার তীব্রতা পরিবর্তনের মান শ্রুতিসীমার মধ্যে থাকা জরুরি। শব্দের উচ্চ শ্রুতিসীমার বেশি তীব্রতা স্বাভাবিক শ্রবণক্রিয়ায় বাধার সৃষ্টি করে। ফলে শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পেয়ে ধীরে ধীরে কানের শ্রুতি গ্রহণের ক্ষমতা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া শব্দের অতিরিক্ত তীব্রতা শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বজ্রপাতের শব্দের মতো দুয়েকটি ছাড়া শব্দদূষণের বেশিরভাগ কারণই মানুষসৃষ্ট। স্বাভাবিকভাবে কথোপকথনের সময় সৃষ্টি হওয়া ৬০ ডেসিবেল শব্দে কোনো দূষণ হয় না। তবে এক জায়গায় বেশিসংখ্যক মানুষ একত্রিত হলে সবার ধীরস্বরে কথা বলাও দূষণের সৃষ্টি করে। সুরবর্জিত উচ্চ তীব্রতাসম্পন্ন শব্দ মানবদেহে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। শব্দদূষণের প্রত্যক্ষ প্রভাবে মানুষের শ্রবণশক্তির উপর অস্থায়ী বা স্থায়ী যেকোনো ধরনের ক্ষতি হতে পারে যা কালক্রমে শ্রবণশক্তিহীনতা থেকে বধিরত্বে রূপ নিতে পারে। সুরবর্জিত তীব্র শব্দ পরোক্ষভাবে মানুষের দেহে স্নায়ুতন্ত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্নায়ুতন্ত্রের উপর এ ধরনের সুরবর্জিত উচ্চমাত্রার শব্দের প্রভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া, রক্তচাপ, শ্বাসক্রিয়া, দৃষ্টিশক্তি এমনকি মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপে অস্থায়ী বা স্থায়ী প্রভাব ফেলে। উচ্চমাত্রার শব্দদূষণে হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পায়। হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। স্নায়ুতন্ত্রের সক্রিয়তা বেড়ে দেহের চলাচলে গতি-প্রকৃতির ক্রিয়া বিঘ্নিত হতে পারে। হৃৎপিণ্ডের ও মস্তিষ্কের কোষের উপর অক্সিজেনের অভাবজনিত সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। একাগ্রতা হ্রাস পেয়ে হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া এবং মাথাধরার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। কখনো উচ্চ মাত্রার সুরবর্জিত শব্দের কারণে কানের পর্দা ছিঁড়ে গিয়ে আংশিক বা পূর্ণ বধিরতা সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি বাতাসে ছড়িয়ে পড়া সুরবর্জিত শব্দদূষণের কারণে অন্যান্য প্রয়োজনীয় শব্দ শুনতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে। শব্দদূষণে মানবদেহের রক্তের শর্করার উপর প্রভাব ফেলে। রাত্রিকালীন দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। এমনকি সুরবর্জিত উচ্চমাত্রার শব্দে মানসিক অবসাদ সৃষ্টি ও স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে।

শব্দদূষণরোধে প্রয়োজন ব্যক্তিগত, প্রযুক্তিগত এবং আইনগত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ। বাড়িঘরে বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত রেডিও, টেলিভিশনের শব্দ যথাসম্ভব কমিয়ে শুনতে হবে। পেশাগত কাজে শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রপাতিতে শব্দ প্রতিরোধক যন্ত্র লাগিয়ে নিতে হবে। আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত লাউড স্পিকারের শব্দ সীমিত রাখতে হবে। মূলত যানবাহন, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, কলকারখানা থেকে যে অনাকাঙ্ক্ষিত উচ্চশব্দ উত্থিত হয় তা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে রোধ করা সম্ভব। শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি উন্নত প্রযুক্তি মানসম্পন্ন হলে তা থেকে অপেক্ষাকৃত কম শব্দ রেরোবে যা শব্দদূষণরোধে সহায়তা করবে। উচ্চমাত্রার শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রে শব্দ প্রতিরোধক আচ্ছাদন ব্যবহার করলে তা থেকে শব্দদূষণ হবে না। স্থলপথের পরিবহন এবং বায়ুযানের চলাচলজনিত সামাজিক শব্দদূষণও প্রযুক্তিগত উপায়ে রোধ করা সম্ভব। সড়ক পরিবহনে ব্যবহৃত যানবাহনে কম শব্দ বেরোয়, এ ধরনের ইঞ্জিনের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা জরুরি।

বাংলাদেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় স্পষ্ট বলা আছে কোন এলাকায় দিনের কোন সময়ে, কি ধরনের শব্দদূষণ করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। শব্দদূষণের জন্য দোষী হিসেবে কেউ প্রমাণিত হলে প্রথম অপরাধের জন্য এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা দুই ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয়দণ্ড দেওয়ার কথা বলা রয়েছে। বিধান রয়েছে, আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ এবং ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের চারপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন শহরকে নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা- এ ৫ ভাগে ভাগ করে এলাকার দিন ও রাতভেদে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীনে বলা আছে, সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণ কাজে ব্যবহারের কোনো যন্ত্র চালানো যাবে না। ভয়াবহ শব্দ সৃষ্টিকারী হাইড্রলিক হর্ন বন্ধে নির্দেশনা চেয়ে ২০১৭ সালে রিট করা হলে হাইকোর্ট রাজধানীতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তা বন্ধের নির্দেশ দেন। এ আদেশে হাইড্রলিক হর্ন আমদানিও নিষিদ্ধ করা হয়। এ আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন জরুরি। আকাশপথে চলাচলকারী বাহনে কম শব্দদূষণ সৃষ্টিকারী ইঞ্জিন এরই মধ্যে বের হয়েছে। উৎসব, আয়োজনে মাইক বা লাউড স্পিকার বাজানোর জন্য শব্দসীমা নির্ধারণ করা অত্যাবশ্যক।

বর্ষবরণের মতো উৎসব আয়োজনে বা থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনে আনন্দ-উচ্ছ্ব¡াসজনিত পরিবেশদূষণরোধে ফানুস ওড়ানো আতশবাজি ও পটকা ফোটানো বন্ধে আইনের প্রয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে। এ লক্ষ্যে এসব পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা দরকার। এসবের বদলে নতুন প্রযুক্তিনির্ভর পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। পত্র-পত্রিকার প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের আতশবাজি, পটকা ও ফানুস দিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্ব¡াস প্রকাশের পরিবেশ দূষণের নেতিবাচক দিক তুলে ধরতে পারেন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close