সৈয়দা আনিকা রহমান

  ১১ জানুয়ারি, ২০২৫

মুক্তমত

আইনশৃঙ্খলার কঠোর বাস্তবায়ন জরুরি

ফারসি ভাষার শব্দ আইন। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Law’ যার আভিধানিক অর্থ হলো- ‘স্থির’ ও ‘অপরিবর্তনীয়’। বিভিন্ন দার্শনিক ও আইনবিদ নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আইনকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কিন্তু আইনের সংজ্ঞা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল। আইন বলতে সাধারণভাবে সমাজস্বীকৃত এবং রাষ্ট্রকর্তৃক অনুমোদিত নিয়মকানুনকে বোঝায় যা মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এরিস্টটল বলেছেন, ‘সমাজের যুক্তিসিদ্ধ ইচ্ছার অভিব্যক্তিই হচ্ছে আইন।’

আইনবিদ জন অস্টিনের মতে, ‘সার্বভৌম শক্তির আদেশই আইন।’ বাংলাদেশ সংবিধানের ‘১৫২’ নম্বর অনুচ্ছেদে আইনের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আইন অর্থ কোনো আইন, অধ্যাদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপআইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনো প্রথা বা রীতি। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রতিটি নাগরিককে স্ব স্ব অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে, দেশের আইন দুর্বলতার কোঠায় পৌঁছেছে। যে যেভাবে পারছে যেকোনো অপরাধ করে গাঢাকা দিচ্ছে। অথচ প্রশাসন কি আদৌও এ বিষয়ে সজাগ? জুলাই-বিপ্লবের পর থেকে একদল চুরি-ডাকাতিকে বেছে নিয়েছে জীবিকার প্রধান মাধ্যম হিসেবে। যেহেতু আইনের কঠোরতার ঘাটতি সেহেতু অসৎ লোক তার সুযোগ গ্রহণ করবেই। এটি কারো কাছে হয়েছে পেশা, কারো কাছে হয়েছে নেশা। মনে করেন, আপনি আপনার এক বছরের সঞ্চয় ব্যাংক থেকে তুলে এনে বাড়ি ফেরার পথে ঢাকা শহরের কোনো এক হাইওয়ের জ্যামে আটকে আছেন, ৫ মিনিটের মধ্যে রাস্তা খালি হয়ে যাওয়ার সঙ্গে দেখলেন আপনার বাম হাতে থাকা টাকার কালো ব্যাগটা ও আপনার হাত খালি করে দিয়ে চলে গেছে। আপনি ছুটে গেলেন নিকটস্থ থানায়। অভিযোগপত্র জমা দিলেন অথচ তাদের থেকে কোনো সাড়া পেলেন না। আপনি দিন-রাত এক করে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলেন, কিন্তু আপনার খালি হাত আর পূর্ণ হলো না। এবার আসি রাস্তাঘাটে নারীরা কতখানি আইনের সুবিধা পাচ্ছে। সুযোগ পেলেই সুশীল মুখোশধারী কিছু পুরুষ মেয়েদের হেয়প্রতিপন্ন করছে, স্কুল, কলেজের কর্মচারী থেকে শুরু করে লোকাল বাসে চড়া লোকজন পর্যন্ত নারীদের ন্যূনতম সম্মান দিতে নারাজ। বাসে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত সিট ও আজকাল দেখা যায় পুরুষদের দখলে। এটাই কি আইন?

মাদকদ্রব্য সেবন আজকাল ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে ছেলে সিগারেটের স্বাদ গ্রহণ করেনি সে বন্ধু মহলে ব্যাকডেটেড নামে খ্যাত। ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আজকাল মোড়ে মোড়ে মেয়েদের মুখ থেকে ধোঁয়া ছাড়ার প্রতিযোগিতা চলছে। বাংলা নববর্ষ থেকে শুরু করে ইংরেজি নববর্ষ পর্যন্ত মদ্যপান ছাড়া বর্ষবরণ হচ্ছে না পরিপূর্ণ। অথচ বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ এবং মদ্যপান নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯১৫ দ্বারা মদ্যপান নিয়ন্ত্রিত। অনিয়ম বা অবৈধভাবে মদ সংরক্ষণ, পরিবহন বা সেবনের জন্য ৬ মাস থেকে ৫ বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। আদৌও কি এ আইন কার্যকর হয়েছে? একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা গোটা বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। সে তার নেশার দ্রব্যচাহিদা মেটানোর জন্য রক্তের সম্পর্ক ভুলে খুনের পন্থা অবলম্বন করে টাকা জোগাড় করেছে এমন কুৎসিত উদাহরণ এর প্রমাণও আমাদের দেশে বিদ্যমান। এটা যদি সমাজচিত্র হয় তাহলে আইন কি করে সমাজের দর্পণস্বরূপ? অপরাধীকে ধরার নূ্যূনতম চেষ্টা করা হয় না, তার শাস্তির বিধান কার্যকর করা হচ্ছে না, মোটা অঙ্কের টাকা প্রশাসনকে ধরিয়ে দিয়েই সে নিজেকে পবিত্র করে তুলছে। এসব দাগী আসামিদের যদি হালকা হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে সমাজের ভবিষ্যৎ চিত্র কেমন হবে, তা কি আদৌ দর্শনযোগ্য? কোনো রাষ্ট্রে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হলে আইন জানা ও আইন মানা অপরিহার্য। আইন বিজ্ঞানের মূলনীতির একটি হচ্ছে ‘ওমহড়ৎধহপব ড়ভ ষধি রং হড় বীপঁংব’ অর্থাৎ আইন না জেনে আইন ভঙ্গ বা অপরাধ সংগঠন করলে আইনের অজ্ঞতার অজুহাত তাকে অপরাধের দায়মুক্তি দেবে না। মানুষ শুধু শাস্তির ভয়ে আইন মান্য করবে তা নয়। বরং আইনের বিভিন্ন উপযোগিতা আইন জানা ও আইন মানার অন্যতম কারণ। আইন ব্যক্তিগত ইচ্ছাপ্রসূত স্বেচ্ছাচারিতা ও পক্ষপাত প্রতিরোধ করে।

আইনের কঠোর বাস্তবায়নই পারে দেশকে মুক্তির পথ দেখাতে। কর্তৃপক্ষের উচিত সময়ের এ দাবিকে সামনে রেখে শৃঙ্খলা আনয়নে ভূমিকা পালন করার প্রতি মনোযোগ দেওয়া। সেইসঙ্গে সাধারণ নাগরিকদের প্রতি আহ্বান, আসুন ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা বাদ দিই, একযোগে রাষ্ট্রের সংস্কারে মনোনিবেশ করি। শান্তি-শৃঙ্খলাবেষ্টিত নিরাপদে বাসযোগ্য একটি রাষ্ট্র উপহার দিই নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close