হৃদয় পান্ডে

  ০৯ জানুয়ারি, ২০২৫

দৃষ্টিপাত

ইতিহাস বিকৃতি জাতীয় চেতনাকে বিভ্রান্ত করে

ইতিহাস একটি জাতির আত্মপরিচয়। এটি অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান গড়ে তোলে এবং ভবিষ্যতের পথ নির্দেশ করে। এর সত্যতা ও নিরপেক্ষতা একটি জাতির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। কিন্তু যখন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়, তখন তা শুধু অতীতের প্রতি অবিচার নয়, বরং বর্তমান প্রজন্ম এবং ভবিষ্যতের জন্যও গভীর বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক গোষ্ঠী এবং সরকার জাতিকে বিভ্রান্ত করার কাজ করে। তারা নিজেদের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা পরিবর্তন করে কিংবা আংশিকভাবে উপস্থাপন করে। এ প্রবণতা কোথাও বিভাজন তৈরি করে, কোথাও ঘৃণার আগুন ছড়ায়। প্রশ্ন ওঠে, রাজনৈতিক ফায়দা লুটের জন্য এমন কর্মকাণ্ড কতটা ন্যায়সঙ্গত বা গ্রহণযোগ্য?

ইতিহাস বিকৃতির রূপ এবং পদ্ধতি : ইতিহাস বিকৃতির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো-সত্যকে আংশিকভাবে বা সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করা। অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা ব্যক্তিত্বের ইতিবাচক দিককে বাড়িয়ে তোলা হয়, আবার নেতিবাচক দিকগুলোকে চেপে রাখা হয়। উদাহরণস্বরূপ- কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনকে গৌরবান্বিত করার জন্য তার সীমাবদ্ধতাগুলো আড়াল করা হয়। এর ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম একটি পক্ষপাতদুষ্ট চিত্র গ্রহণ করে, যা জাতীয় চেতনাকে বিভ্রান্ত করে।

অতিরঞ্জন ও অপব্যাখ্যার মাধ্যমেও ইতিহাসকে প্রভাবিত করা হয়। কোনো ঘটনা বা ব্যক্তিত্বকে বাস্তবের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট আদর্শ বা মতবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ- জাতীয়তাবাদ বা ধর্মীয় পরিচয়ের নামে ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট অংশকে অতিমাত্রায় জোর দিয়ে উপস্থাপন করা হয়। এটি শুধু ঐতিহাসিক সত্যকে বিকৃত করে না, বরং সমাজে বিভেদের বীজ বপন করে।

পাঠ্যপুস্তক এবং গণমাধ্যম ইতিহাস বিকৃতির প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনেক দেশে পাঠ্যপুস্তক এমনভাবে তৈরি করা হয়, যেখানে রাজনৈতিক বা আদর্শগত প্রভাব স্পষ্ট। এ প্রক্রিয়ায় শিশুদের মন গড়ে ওঠে এমন একটি বিকৃত চেতনার ওপর, যা আসল সত্য থেকে অনেক দূরে। একইভাবে- গণমাধ্যমের মাধ্যমে ইতিহাসের বিকৃত উপস্থাপনা সমাজে বিভ্রান্তি এবং বিভাজন তৈরি করে।

সবচেয়ে মারাত্মক হলো বিভাজনের রাজনীতি। এখানে ইতিহাসকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায়। এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের একটি চরম কৌশল, যা সমাজে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতার কারণ হতে পারে।

ইতিহাস বিকৃতির এ রূপ ও পদ্ধতিগুলো শুধু একটি জাতির শিক্ষাকে ব্যাহত করে না বরং এটি প্রজন্মের ওপর মানসিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষতিসাধন করে। সত্য ইতিহাস থেকে দূরে সরে গেলে একটি জাতি তার মূল শেকড় হারিয়ে ফেলে এবং বিভ্রান্তির পথে এগিয়ে যায়।

ইতিহাস বিকৃতির প্রভাব : ইতিহাস বিকৃতির প্রভাব কেবল একটি জাতির অতীতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি তার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। একটি জাতির ঐক্য, শিক্ষাব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক অবস্থান- সবই এ প্রভাবের শিকার।

বিকৃত ইতিহাস জাতীয় সংহতির জন্য একটি বড় হুমকি। এটি জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে এবং সমাজে অবিশ্বাসের বীজ বপন করে। জাতি যখন নিজেদের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্ত থাকে তখন তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অভাব দেখা দেয়। বিভ্রান্ত জাতি নিজেদের মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়।

শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিহাস বিকৃতির প্রভাব আরো গভীর। পাঠ্যপুস্তকে সঠিক তথ্যের অভাব শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে এবং তাদের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ গড়ে উঠতে বাধা দেয়। বিকৃত ইতিহাস শিক্ষার্থীদের এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি দেয়, যা ভবিষ্যতে তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে দুর্বল করে। এটি একটি প্রজন্মকে শুধু বিভ্রান্ত করে না, বরং তাদের সমগ্র জাতির জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইতিহাস বিকৃতির প্রভাব দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যখন কোনো দেশ তাদের ইতিহাস বিকৃত করে, তখন এটি তাদের আন্তর্জাতিক পরিচিতি এবং বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এটি কেবল কূটনৈতিক সম্পর্ককেই জটিল করে না, বরং বৈশ্বিক রাজনীতিতে দেশের অবস্থানকেও দুর্বল করে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- ইতিহাস বিকৃতি একটি জাতির সত্যের প্রতি শ্রদ্ধার অভাবকে প্রকাশ করে। এটি জাতিকে এমন একটি অবস্থানে নিয়ে যায়, যেখানে তারা কেবল অতীতের ভুল পুনরাবৃত্তি করে। একটি জাতি যখন সত্যকে উপেক্ষা করে, তখন তাদের ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণেও ত্রুটি দেখা দেয়। সঠিক ইতিহাস জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি দেয়, আর বিকৃত ইতিহাস তাদের পিছিয়ে দেয়।

ইতিহাস বিকৃতির এ ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে আমাদের সবারই সচেতন হওয়া জরুরি। একটি জাতির সঠিক পথচলা নিশ্চিত করতে ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সত্যের প্রতি আনুগত্য অত্যন্ত প্রয়োজন।

রাজনৈতিক ফায়দা লুট : ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা লুট একটি মারাত্মক কৌশল, যা সমাজের ভিত্তি দুর্বল করে দেয়। এটি কেবল জনগণের আবেগ ও চিন্তাকে প্রভাবিত করার মাধ্যম নয়, বরং ক্ষমতা ধরে রাখার একটি সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া। নির্বাচনী রাজনীতিতে এ কৌশলটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। রাজনৈতিক দলগুলো ইতিহাসকে নিজেদেরমতো করে সাজিয়ে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। ঐতিহাসিক ঘটনা বা ব্যক্তিত্বকে আংশিকভাবে উপস্থাপন, অতিরঞ্জন বা আড়াল করার মাধ্যমে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়। এর ফলে ইতিহাসের প্রকৃত সত্য ধামাচাপা পড়ে যায় এবং বিভ্রান্তিকর ভাবনা সমাজে প্রচলিত হয়।

জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রচেষ্টা কোনো নতুন ঘটনা নয়। ইতিহাসে দেখা গেছে, অনেক রাষ্ট্র বা নেতৃত্ব তাদের রাজনৈতিক অবস্থান জোরদার করতে জনগণের আবেগকে উত্তেজিত করার জন্য ইতিহাস বিকৃত করেছে। উদাহরণস্বরূপ- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আমাদের দেশে যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে তা কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের সুবিধামতো মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা উপস্থাপন করে, যা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে এবং জনগণের ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

বিশ্বপরিসরেও ইতিহাস বিকৃতির নজির অসংখ্য। নাৎসি জার্মানি থেকে শুরু করে উপনিবেশবাদী শক্তিগুলোর ইতিহাস পুনর্লিখনের প্রয়াস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ইতিহাসের সত্যতা লঙ্ঘনের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।

বিকৃত ইতিহাসের সাহায্যে বিরোধী পক্ষকে জনগণের চোখে খলনায়ক হিসেবে তুলে ধরা একটি সাধারণ কৌশল। এটি জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে এবং বিরোধী দলের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করতে ব্যবহৃত হয়। ফলে সমাজে স্থিতিশীলতার অভাব দেখা দেয় এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশে শূন্যতা তৈরি হয়।

শেষ কথা : ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা লুট সাময়িকভাবে কোনো দল বা গোষ্ঠীর জন্য সুবিধাজনক মনে হতে পারে, তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এক জাতির ভবিষ্যৎকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি কেবল সামাজিক বিভাজন তৈরি করে না, বরং প্রজন্মের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং শিক্ষার মানের অবক্ষয় ঘটায়।

আমাদের সবার দায়িত্ব হলো- ঐতিহাসিক সত্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। রাজনীতি যেন কখনোই সত্যকে বিকৃত করে তার সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য আমাদের সচেতন, ঐক্যবদ্ধ এবং দায়িত্বশীল হতে হবে। ঐতিহাসিক চেতনার আলোয় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য সঠিক শিক্ষা ও নৈতিকতার চর্চা অপরিহার্য।

লেখক : শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ।

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close