রাকিব হাসান

  ০৬ জানুয়ারি, ২০২৫

দৃষ্টিপাত

ত্রি জিরো ও বাংলাদেশ

ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি মাইক্রোক্রেডিট ধারণার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পরিচিত এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী, তার নতুন উন্নয়ন মডেল ‘ত্রি জিরো’ ধারণা দিয়ে একটি ন্যায়বিচারভিত্তিক, মানবিক ও টেকসই সমাজ গঠনের রূপরেখা প্রদান করেছেন। বর্তমানে ২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই মডেলটি দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং পরিবেশের অবক্ষয়ের মতো তিনটি প্রধান সমস্যার সমাধানে লক্ষ্য স্থির করে। তাই দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশের জনগণও আগ্রহ প্রকাশ করছে ত্রি জিরো তত্ত্ব নিয়ে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে এটি কেবল একটি ভাবনার বিষয় নয়, বরং একটি বাস্তবসম্মত উন্নয়ন নীতি। এটির প্রয়োগ কতটুকু সম্ভব এবং এর সুফলগুলো সম্পর্কে আগ্রহী সাধারণ জনগণও।

ত্রি জিরো : তিনটি প্রধান লক্ষ্য হলো শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণ? ড. ইউনূসের ‘ত্রি জিরো’ ধারণা তিনটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কেন্দ্রীভূত।

শূন্য দারিদ্র্য : ড. ইউনূস মনে করেন, দারিদ্র্য কোনো মানুষের প্রাকৃতিক অবস্থা নয়, এটি একটি মানবসৃষ্ট সমস্যা। তার মাইক্রোক্রেডিট মডেলের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, দরিদ্র মানুষদের আর্থিক ক্ষমতায়ন করে তাদের দারিদ্র্যমুক্ত করা সম্ভব। বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম এই ধারণার প্রমাণ। বাংলাদেশে এখনো প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। এই প্রেক্ষাপটে ‘শূন্য দারিদ্র্য’ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও, এটি অর্জনযোগ্য। সামাজিকব্যবসা, যেখানে মূল লক্ষ্য মুনাফা নয় বরং মানুষের সমস্যা সমাধান, দারিদ্র্য নির্মূলে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। দারিদ্রতা সমস্যা নির্মূলের মাধ্যমে বাংলাদেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব।

শূন্য বেকারত্ব : ড. ইউনুসের মতে, প্রতিটি মানুষই উদ্যোক্তা হতে পারে। তিনি মনে করেন অবসর বলতে কোনো শব্দ থাকতে পারে না। প্রতিটি মানুষ ই উদ্যোক্তা হতে পারে। বাংলাদেশে প্রতিবছর হাজার হাজার তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশ করে, কিন্তু পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকেই বেকার থাকে। তিনি বেকারত্ব দূর করতে ‘জব সিকার’ থেকে ‘জব ক্রিয়েটর’ তৈরি করার ওপর জোর দিয়েছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে আত্মনির্ভরশীল করা এবং স্টার্টআপ সংস্কৃতি গড়ে তোলা এই লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হতে পারে।

শূন্য কার্বন নিঃসরণ : পরিবেশ সুরক্ষার জন্য ‘ত্রি জিরো’ মডেলের অন্যতম মূল স্তম্ভ হলো কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা। বাংলাদেশ একটি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের পরোক্ষ ও প্রতক্ষ্য উভয় ক্ষতির সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। তাই জিরো কার্বন নিঃসরণ মডেল বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে। সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো ‘শূন্য নিঃসরণ’ লক্ষ্য অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। ‘গ্রিন টেকনোলজি’ ও সবুজ শক্তির ওপর বিনিয়োগ বৃদ্ধি এই লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হতে পারে। যার ফলে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করা সম্ভব।

বাংলাদেশের জন্য ত্রি জিরো মডেলের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আসা যাক। বাংলাদেশ একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ। তবে দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং পরিবেশগত সমস্যা এখনো বড় বাধা। ড. ইউনূসের ত্রি জিরো মডেল এই সমস্যাগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দিতে পারে। আমরা এক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের উদাহরণ দিতে পারি। ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক মাইক্রোফাইন্যান্সের মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করেছে। এর সফলতা দেখে বোঝা যায়, যদি এই মডেল আরো বিস্তৃত করা হয়, তবে দারিদ্র্য নির্মূল করা সম্ভব।

পাশাপাশি তরুণদের উদ্যোক্তা তৈরির সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ। তারা যদি সঠিক প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তা পায়, তবে তারা দেশের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তাই নবায়নযোগ্য শক্তি এবং সবুজ প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।

ত্রি জিরো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা বাধা রয়েছে। যেমন নীতিনির্ধারণে জটিলতা, সরকারের বিভিন্ন স্তরে নীতির সমন্বয় করা কঠিন। রয়েছে আর্থিক বাধা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জিং। সচেতনতার অভাব, পরিবেশ সুরক্ষা এবং উদ্যোক্তা সংস্কৃতির প্রতি মানুষের সচেতনতা কম। ফলে মডেলটি বাস্তবায়ন করতে হলে সব স্তরের সাহায্য প্রয়োজন বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে। যার ভেতরে অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে ত্রি জিরো। তবে এটি অর্জনের মাধ্যমে একটি টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন সম্ভব। যেমন, দেশের বড় অংশ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম সীমাবদ্ধ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কৃষিজমি হ্রাসের ফলে খাদ্য উৎপাদনে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসলহানি ও খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে, শিল্প খাতের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির অভাবে পরিবেশ দূষণ বাড়ছে, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির অভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও নীতি বাস্তবায়নে বাধা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পর্যাপ্ত বৈদেশিক সহায়তা পেতে দেরি হয়।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘ত্রি জিরো’ মডেল বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি আদর্শ দৃষ্টিভঙ্গি। এটি শুধু দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব দূর করবে না, বরং একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব সমাজ গঠনে সহায়ক হবে। তবে এই মডেলের সফল বাস্তবায়নের জন্য সরকার, বেসরকারি খাত, এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ যদি এই মডেল গ্রহণ করে এবং সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে এটি বিশ্বে উন্নয়নের একটি নতুন উদাহরণ স্থাপন করতে সক্ষম হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close