শীতাব আরাফ ফয়সাল
মুক্তমত
‘র্যাগিং সংস্কার’ কথাটি লজ্জার ও ভীতিকর
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা আগমন করে জ্ঞানের সীমার ব্যাপ্তি প্রসার করতে। জানার ও দেখার দৃষ্টিকে সাবলীল ও মসৃন করতে। সেখানে এসে যদি তাদের কোনো উদ্ভুত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়, তাহলে সেটা অবশ্যই ভীতিকর। ‘র্যাগিং’ ইংরেজি শব্দ যার অর্থ চটানো, উত্তেজিত করা, খ্যাপানো। একেবারে সহজবোধ্য ভাষায় যাকে বলে ‘মানসিক নির্যাতন’। কারণ কাউকে চটানো, খ্যাপানো, উত্তেজিত করা সবকিছুরই মূল হচ্ছে মানসিক চাপ। র্যাগিং একধরনের মানসিক নির্যাতন যেটা অনেক সময় নবাগত শিক্ষার্থীদের বাধ্য করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে।
আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের কিছু রং বদলেছে শুধু। পুরোপুরি র্যাগিং বাতিল হয় নাই। আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয় পর্ব নামক একটা প্রক্রিয়া বিদ্যমান আছে। সিনিয়র ও জুনিয়র পরিচিত হওয়া যে খারাপ সেটা বলছি না। পরিচয় পর্ব কর্মজীবনে ভবিষ্যতে অনেক ক্ষেত্রে অনেকভাবে উপকারী। কিন্তু সেটা হতে হবে স্বেচ্ছামূলক। কে কার সঙ্গে পরিচিত হবে, এটা অবশ্যই একজনের ব্যক্তিস্বাধীনতা। অন্যদিকে যখন বাধ্যতামূলক এই রীতি চালু করা হবে, তখন সেটা হবে মানসিক চাপ দেওয়া। পরিচয় পর্বের নামে মানসিক চাপ সৃষ্টি করা ভীতিকর কারণ তা র্যাগিংয়ের পর্যায়ের শামীল। সিনিয়ররা কোনো যায়গায় ডাকলে, সময়মতো উপস্থিত হতেই হবে, নাহলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, এ ধরনের নানা হুমকি প্রদান করতেও দেখা যায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
হ্যাঁ, ভার্সিটিতে কিছু নিয়ম-কানুন আছে, যেমন কেউ চাইলেই উলঙ্গ হয়ে যেমন ভার্সিটিতে আসতে পারবে না। ঠিক তেমনি একজন জুনিয়র কোনো সিনিয়রের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারবে না। আর যদি তা করে, অবশ্যই জুনিয়রের বিরুদ্ধে নিয়মমাফিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। কিন্তু সেটার মানে এই নয় যে বাধ্যতামূলক পরিচয় পর্ব রীতি চালু থাকবে। কারণ এক এক জনের এক একরকম কাজ থাকে, উদ্দেশ্য থাকে, লক্ষ্য থাকে। সবাই সবক্ষেত্রে পারদর্শী নয়। বিশেষ করে যারা ইন্ট্রোভার্ট প্রকৃতির স্টুডেন্ট তারা বেশিরভাগ সময় মানসিক নির্যাতন ও রূঢ় কথার স্বীকার বেশি হয়। অনেক সময় অনেক অটিস্টিক শিক্ষার্থীদেরও এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়। তখন বিষয়টা মানসিক ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ও নির্যাতনের পর্যায়ে চলে যায়, তখন সেটা র্যাগিংয়ের পর্যায়েই পড়ে। এর অন্য কোনো নাম দিয়ে রং বদলানো যায় না। তাই অবশ্যই র্যাগিং নবাগতদের জন্য এক ভীতির নাম।
পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, আমাদের প্রিয় নবী ও রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.) ছোটদের সালাম দিতেন। কিন্তু অন্যদিকে অনেক সিনিয়রদের জুনিয়ররা সালাম না দিলে যেন তাদের রাতে ঘুমই হয় না। রাস্তা দিয়ে হাটার সময় সালাম না দিলে ম্যানার শেখানোর নামে র্যাগিং তুল্য কাজ করা হয়। করা হয় নানা ধরনের প্রশ্ন : যেমন তুই সালাম দিলি না কেন? এখন দশবার সালাম দিতে হবে। সবার সামনে সিনিয়রদের জুনিয়রদের গালিগালাজ করতেও দেখা যায়। তাদের তখন বলতে দেখা যায়, ‘পরিচিত হওয়া সবার দ্বায়িত্ব’। কিন্তু প্রশ্ন এক যায়গায়, একটা ভার্সিটিতে নবাগতদের আগের সিনিয়র স্টুডেন্ট থাকে বিশ হাজার। তাহলে কতজনের সঙ্গে পরিচিত হবে? ভার্সিটি বাদ দিলাম, একটা ডিপার্টমেন্টেই সিনিয়র থাকে পাঁচশ, তার মানে কি পাঁচশ জনের সঙ্গেই পরিচিত হতে হবে? নাকি যারা একটু হাইলাইটেড সিনিয়রস, যেই সিনিয়রদের সবাই একনামে চেনে, একটু প্রভাব আছে। তাদের সঙ্গেই পরিচিত হতে হবে?
প্রধান সমস্যা হচ্ছে, বড় শিক্ষার্থীদের মধ্যে কর্তামূলক একটা লোভ দেখা যায় যেটা লজ্জাজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বপ্ন নিয়ে আগত একটা গ্রামের সহজ-সরল শিক্ষার্থীকে সবার সামনে সামান্য একটা গালিও যে একজন শিক্ষার্থীর মনের ওপর কতটা প্রভাব ফেলে, এটা অনেক সময় সিনিয়ররা বুঝে উঠতে ব্যর্থ হয়। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) ছোটদের খুব ভালোবাসতেন, ছোটদের সঙ্গে কোমল ভাষায় আদর করে কথা বলতেন। তাই সিনিয়রদের অবশ্যই এই বিষয়গুলো মাথায় রাখা উচিত। কোনো জুনিয়র যদি সিনিয়রের সঙ্গে পরিচিত না হয়, সেটা জুনিয়রের ব্যর্থতা বা জুনিয়রের অলসতা বা তার নিজস্ব চিন্তাধারা। শুধু শুধু তাতে সিনিয়রদের রাগ না করাই উচিত। সেই জন্যই বলতে হবে কেউ যদি বলে যে ‘র্যাগিং বাতিল নয় সংস্কার চাই’ তাহলে তার মধ্যে অবশ্যই কর্তৃত্বমূলক লোভ আছে, অসৎ উদ্দেশ্য আছে। আরেকটা জিনিস দেখা যায়, এক ব্যাচের জুনিয়র শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সিনিয়র শিক্ষার্থীরা খারাপ ব্যবহার করলে। সেই জুনিয়ররা যখন সিনিয়র হয়, তখন আবার তাদের সময় যেই জুনিয়ররা আসে তাদের সঙ্গে সেই আচরণ করে; তাদের সেই জ্বালা মেটাতে প্রতিশোধ নিতে চাই। কিন্তু তারা এটা বোঝে না এরকম করলে বছরের পর বছর কেটে গেলেও র্যাগিং বাতিল সম্ভব নয়।
সরকার র্যাগিং নিষিদ্ধ করলেও অহরহ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো র্যাগিং চলমান। এমন কি চব্বিশের এই গণঅভ্যুত্থানের পরেও, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা ঘটেছে। কেবল ধরন বদলেছে। কিন্তু র্যাগিং নামক অভিশাপ, র্যাগিং নামক মানসিক নির্যাতন বন্ধ হয়নি। সুতরাং এই দুর্ভোগ দূর করতে; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসন ও সরকারের এ ব্যাপারে আরো কঠোর হওয়া উচিত। যাতে র্যাগিং সম্পূর্ণ রূপে বাতিল হয়। কেউ যেন কোনোভাবেই শিক্ষার্থীর জ্ঞান বিকাশের জন্য মানসিক ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে, এবং শারীরিক নির্যাতন বন্ধ হয়। যাতে শিক্ষার্থীরা সাধারণ ও শান্তিপূর্ণভাবে তাদের জ্ঞানের পরিসীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
"