মো. হাসনাইন রিজেন

  ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

ব্লু-ইকোনমিতে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

বিশ্বব্যাংকের মতে, ব্লু-ইকোনমি এমন একটি ধারণা, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং জীবিকার সংরক্ষণকে উন্নীত করতে চায় এবং একইসঙ্গে সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে। সুনীল অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করা, দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করা, সামাজিক পুঁজি সৃষ্টি করা, আয় বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি পরিবেশে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করা।

বেলজিয়ামের অর্থনীতিবিদ গুন্টার পাওলি ১৯৯৪ সালে প্রথম ব্লু ইকোনমি বা নীল অর্থনীতির ধারণা দেন। ২০১২ সালে রিও+২০ সম্মেলনে এ ধারণাটি বৈশ্বিক পর্যায়ে গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশ যার বিশাল আয়তন রয়েছে। বাংলাদেশে ব্লু-ইকোনমি বলতে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের সম্পদকে বোঝায়। বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত সম্পদ বাংলাদেশে ব্লু-ইকোনমির অন্যতম প্রধান সম্পদ।

আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় মোট এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকা এখন বাংলাদেশের। সঙ্গে আছে ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের প্রাণিজ-অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রে বিরোধপূর্ণ ১৭টি ব্লকের ১২টি পেয়েছে বাংলাদেশ।

ভারতের কাছ থেকে দাবিকৃত ১০টি ব্লকের সব পেয়েছে বাংলাদেশ। এই বিপুলসংখ্যক সম্পদের ব্যবহারের ফলে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন লাভবান হচ্ছে। আর এই ব্লু-ইকোনমিকে সঠিকভাবে বিকাশের মাধ্যমে দেশের জিডিপি বৃদ্ধির একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল ও গ্যাস রয়েছে। এখানে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হলে তা দেশের ব্লু-ইকোনমির একটি বড় শক্তি হয়ে উঠবে। দেশের সমুদ্রসীমায় অনুসন্ধান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট বা মিথেন গ্যাসের জমাট স্তরের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার একান্ত অর্থনৈতিক এলাকায় শূন্য দশমিক ১১ থেকে শূন্য দশমিক ৬৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট সম্ভাব্য প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট থাকার বিষয়টি অনুমিত হয়েছে, যা ১৭ থেকে ১০৪ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাসের সমান।

জাতিসংঘ ২০১৫ সাল পরবর্তী যে টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে তার মূলকথাই হচ্ছে ব্লু-ইকোনমি। বিশেষজ্ঞদের মতে ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০০ কোটি। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাবার যোগান দিতে তখন সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। তাই সমগ্র বিশ্বে ক্রমশ ব্লু-ইকোনমি ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে।

ব্লু-ইকোনমির মূল ভিত্তি হচ্ছে টেকসই সমুদ্র নীতিমালা। বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্র অর্থনীতি বহুবিধভাবে অবদান রেখে চলেছে। বছরব্যপী ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে সমুদ্র ঘিরে। বিশ্বের ৮০৭ কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের যোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও প্রাণী। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে।

বিগত বছরগুলোতে যতগুলো আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছে তার সবগুলোতেই ব্লু-ইকোনমি ছিল আলোচনার কেন্দ্রেবিন্দু। ২০১২ সালে সমুদ্রবিষয়ক এশীয় সম্মেলন, ২০১৩ সালে বালিতে অনুষ্ঠিত খাদ্য নিরাপত্তা এবং ব্লু-গ্রোথ ইত্যাদি সম্মেলনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অর্থনৈতিক সহায়তা এবং উন্নয়ন সংস্থা (ঙঊঈউ), জাতি সংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (টঘঊচ), বিশ্বব্যাংক, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ), ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ঊট)-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উন্নয়ন কৌশলের মূলেও থাকছে ব্লু-ইকোনমি। আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন ছোট বড়-দেশ ব্লু-ইকোনমিনির্ভর উন্নয়ন কৌশল প্রণয়ন করছে।

ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্রনির্ভর। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি এমনকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যে তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা গেলে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদের মূল্যমান জাতীয় বাজেটের দশগুণ হবে। দ্য জাকার্তা পোস্টে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে দ্য লমবক ব্লু-ইকোনমি বাস্তবায়ন কর্মসূচি ৭৭ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করার পাশাপাশি প্রতিবছর ১১৪.৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করবে।

বাংলাদেশের ব্লু-ইকোনমি জোন তথা বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সম্পদের ব্যবহার বাংলাদেশকে যেমন দিতে পারে আগামী দিনের জ্বালানি নিরাপত্তা, তেমনি বদলে দিতে পারে সামগ্রিক অর্থনীতির চেহারা। এমনকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করাও সম্ভব। বঙ্গোপসাগর হতে প্রতিবছর প্রায় ৮ মিলিয়ন টন মাছ ধরা হলেও আমরা মাত্র ০.৭ মিলিয়ন টন মাছ ধরতে পারছি। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে মাছ আহরণ আরো বাড়ানো সম্ভব।

অর্থনৈতিক অঞ্চলের ২০০ মিটারের অধিক গভীরতায় অতি পরিভ্রমণশীল মৎস্য প্রজাতি এবং গভীর সমুদ্রে টুনা ও টুনা জাতীয় মৎস্যের প্রাচুর্য রয়েছে। সামুদ্রিক বিভিন্ন জীব থেকে কসমেটিক, পুষ্টি, খাদ্য ও ওষুধ পাওয়া যায় যা বিদেশে বিক্রি করার মধ্যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। সামুদ্রিক বিভিন্ন শৈবাল থেকে ইতোমধ্যেই চড়ষুঁহংধঃঁৎধঃবফ ভধঃঃু ধপরফং (চটঋঅং) যেমন ড়সবমধ-৩ ধহফ ড়সবমধ-৬ নামের ধহঃরড়ীরফধহঃং সমূহ বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা সম্ভব।

প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ টন লবণ উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। লবণ চাষে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহার করে লবণ বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। বঙ্গোপসাগরে ভারী খনিজের (হেডি মিনারেল) সন্ধান পাওয়া গেছে। ভারী খনিজের মধ্যে রয়েছে ইলমেনাইট, টাইটেনিয়াম অক্সাইড, ব্লুটাইল, জিরকন, গানেট, ম্যাগনেটাইট, মোনাজাইট, কোবাল্টসহ অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। এসব মূল্যবান সম্পদ সঠিক উপায়ে উত্তোলন করতে পারলে হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

বিশ্ববাণিজ্যের ৯০ ভাগই সম্পন্ন হয় সামুদ্রিক পরিবহনের মাধ্যমে। বিশাল অর্থনৈতিক এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য দ্রুত স্থানীয় জাহাজ তৈরির কোম্পানিগুলোকে সুযোগ সুবিধা প্রদান করে আরো উন্নতমানের বাণিজ্য জাহাজ বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত করা প্রয়োজন। গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি, বাংলাদেশের বন্দরে সুযোগ সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জাহাজসমূহের ফিডার পরিষেবা কার্যক্রম বাড়ানোর মাধ্যমে আমাদের বন্দরসমূহ কলম্বো, সিঙ্গাপুর বন্দরের মতো আরো গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে খুব দ্রুত প্রয়োজনীয় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন।

সমুদ্র উপকূলীয় খনিজ বালি, খনিজ ধাতু উত্তোলন করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের কোবাল্ট, কপার, জিংক এবং জধৎব ঊধৎঃয ঊষবসবহঃ (জঊঊ) ধাতুসমূহের উৎপাদনের ১০ ভাগ আসবে সমুদ্র থেকে। বাংলাদেশ এ খাতে কোনো ধরনের গবেষণা ও অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি বিধায় বঙ্গোপসাগরে এসব মূল্যবান খনিজ ধাতু এখনো চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। উপকূলীয় পর্যটন থেকে বিশ্বের জিডিপির ৫ শতাংশ আসে এবং বিশ্বের ৬-৭ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান এই খাত থেকে হয়।

বাংলাদেশে বিশ্বে সবচেয়ে বড় ১২০ কিমি দৈর্ঘ্যরে অবিচ্ছিন্ন বালুময় সমুদ্রসৈকত রয়েছে। এক্ষেত্রে উপকূল অঞ্চলে পর্যাপ্ত বিনোদন ও মনোরম পরিবেশের ব্যবস্থা করতে পারলে এ খাত থেকে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া কৃত্রিম দ্বীপ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ভূমি বাড়ানো যায় এবং পরিপূর্ণ চর্চার মাধ্যমে পর্যটন খাত হিসেবে দ্বীপের উন্নয়ন ঘটানো যায়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেওয়া প্রয়োজন।

সমুদ্রের ওয়েভ এবং জোয়ার-ভাটাকে ব্যবহার করেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা এবং সমুদ্রের উপরের ও নিচের স্তরের তাপমাত্রার পার্থক্য থেকে ঙপবধহ ঞযবৎসধষ ঊহবৎমু ঈড়হাবৎংরড়হ (ঙঞঊঈ) প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এজন্য গবেষণার পাশাপাশি প্রচুর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন।

পর্যাপ্ত নীতিমালার ও সঠিক কর্মপরিকল্পনার অভাব। দক্ষ জনশক্তির অভাব। প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব। সম্পদের পরিমাণ ও মূল্য সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাব। মেরিন রিসোর্সভিত্তিক পর্যাপ্ত গবেষণা না হওয়া। ব্লু-ইকোনমি সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক যোগাযোগের অভাব। সমুদ্রে গমন এবং গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য গবেষণা জাহাজ না থাকা।

ব্লু-ইকোনমি বাস্তবায়নে যেসব পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে : ফিজিক্যাল অ্যান্ড স্পেস ওশানোগ্রাফিক সম্পর্কিত বেইজ লাইন-ডেটা নির্ধারণ। পটেনশিয়াল ফিশিং জোন চিহ্নিতকরণ। সমুদ্র পর্যবেক্ষণ এবং রিয়েলটাইম ডেটা সিস্টেম চালুকরণ। ভূ-তাত্ত্বিক ওশানোগ্রাফি সম্পর্কিত বেইজ লাইন ডোটা নির্ধারণ। বায়োলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি সম্পর্কিত বেইজ লাইন ডেটা নির্ধারণ। একোয়া কালচার করা। কেমিক্যাল ওশানোগ্রাফি সম্পর্কিত বেইজ লাইন ডোটা সমৃদ্ধকরণ। সমুদ্র তীরবর্তী দূষণরোধ। ওশানোগ্রাফিক ডেটা সেন্টার স্থাপন, উন্নয়ন এবং ডেটা সমৃদ্ধকরণসহ সমুদ্রবিষয়ক তথ্য ও প্রযুক্তির উন্নয়ন।

সমুদ্রবিষয়ে দক্ষ জনবল তৈরিসহ সমুদ্র বিষয়ে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম। বাংলাদেশে ব্লু-ইকোনমি একবিংশ শতাব্দীতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। পরিকল্পিত ও টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনবে না, বরং পরিবেশ সংরক্ষণ এবং উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত করতেও ভূমিকা রাখবে। এখন সময় এসেছে ব্লু-ইকোনমি উদ্যোগগুলোকে কার্যকর করে তুলতে একটি সমন্বিত রোডম্যাপ প্রণয়নের।

লেখক : শিক্ষার্থী, হাটহাজারী সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close