মাহফুজুর রহমান মানিক
দৃষ্টিপাত
মান না বাড়ালে শিক্ষায় ভারতমুখিতা কমবে না
উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশের শিক্ষার্থী অনেকের পছন্দের তালিকায় থাকে ভারত। এমনকি পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে বিদেশি শিক্ষার্থীর তালিকায় বাংলাদেশিদের অবস্থান তৃতীয়। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখায় দ্বিমত নেই। তাই বলে এমন পরিস্থিতি যাতে না দাঁড়ায়, আমরা প্রতিবেশী দেশটির প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ব। এরইমধ্যে গরু উৎপাদনে সফল উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। ভারত গরু রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় ধীরে ধীরে হলেও বাংলাদেশ এখন গরুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের একধরনের টানাপোড়েন চলছে। এমন চলতে থাকলে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী নেওয়া বন্ধের ঘোষণায়ও বিস্মিত হব না। সেজন্য ভাবতে হবে আগেই।
বাংলাদেশ থেকে ঠিক কত শিক্ষার্থী ভারতে পড়তে যায়? পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর দুই থেকে আড়াই হাজার বাংলাদেশি ভারতে পড়াশোনা করতে যায়। বাংলাদেশের তুলনায় প্রতিবেশী নেপাল ও আফগানিস্তানের শিক্ষার্থী বরং বেশি। অল ইন্ডিয়া সার্ভে ফর হায়ার এডুকেশনের ২০২১-২২ সালের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট-বিষয়ক তথ্যের ভিত্তিতে হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে এ চিত্র তুলে ধরা হয়। একইসঙ্গে এটাও বলা দরকার, ভারত থেকেও শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে পড়তে আসে। বিশেষ করে আমাদের মেডিকেল কলেজগুলোতে পড়তে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের শিক্ষার্থীই আসে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে মোট ১ হাজার ৬৭ জন ভারতীয় বাংলাদেশের মেডিকেলে পড়তে এসেছে।
তার মানে, ভারতে যেমন শিক্ষার্থীরা পড়তে যাচ্ছে তেমনি ভারত থেকেও বাংলাদেশে পড়তে আসছে। তবে আসার তুলনায় যাওয়ার হার বেশি। উচ্চশিক্ষার আন্ডার গ্র্যাজুয়েট, গ্র্যাজুয়েট ও পিএইচডি পর্যায়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা সাধারণত ভারতে পড়তে যায়। এর কারণ খুবই স্পষ্ট- শিক্ষার মান। চলতি বছরের মাঝামাঝি যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কিউএস বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে বিশ্বের দেড় হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ভারতের ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাকিস্তানের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করে নিয়েছে। আর ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ থেকে। ভারতে ২০টির অধিক আইআইটি আছে। যেগুলোর শিক্ষার মান বিশ্বস্বীকৃত। এর বাইরে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে যায়। আবার ভারতে উচ্চশিক্ষার জন্য অন্যতম জনপ্রিয় বৃত্তি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স (আইসিসিআর)। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এ বৃত্তি দেয় প্রতিবেশী দেশটি। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী এ বৃত্তি পেয়ে ভারতে পড়তে গেছে বা যাচ্ছে।
বৃত্তির চেয়েও অন্তত ৩ গুণ শিক্ষার্থী প্রতিবছর ভারতে পড়তে যাওয়ার বড় কারণ আমাদের অনুসন্ধান করা দরকার। উচ্চশিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরে যেতেই পারে। তবে এ প্রবণতা বাড়তে দেওয়ার ক্ষেত্রে নানাবিধ বিপদ লক্ষণীয়। ‘ব্রেন ড্রেন’ বা মেধা পাচারের পাশাপাশি আমাদের উচ্চশিক্ষার মান বাড়ানোর তাগিদও কমে যেতে পারে। অথচ উচ্চশিক্ষার বিশ্বমান নিশ্চিত করতে পারলে ভারত তো বটেই, হয়তো অন্য দেশে যাওয়ার প্রবণতাও কমবে। শুধু তাই নয়, প্রতিবেশী ও অন্য দেশ থেকে শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশে পড়তে আসার হার অনেক বেড়ে যাবে। এখন অন্যান্য দেশ থেকে সাধারণত মেডিকেলে পড়তে শিক্ষার্থীরা আসে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান তৈরি ও গবেষণার দিক থেকে বিশ্বস্বীকৃতি অর্জন করলে অন্যরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়তে আসবে।
ভারতের সঙ্গে শিক্ষার ‘এক্সচেঞ্জ’ বন্ধ করার কথা বলছি না। বরং শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে উভয়ের জন্য উইন উইন পরিবেশ তৈরি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের শিক্ষার্থীরা সেখানে পড়তে যাবে, আবার তাদের শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসবে। এখানে আমরা যেন একতরফা শিক্ষাক্ষেত্রে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে না পড়ি। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেই মানে নিয়ে যাওয়ার মতো আমাদের জনসম্পদ ও আর্থিক সংগতির ঘাটতি আছে বলে আমি মনে করি না।
বিশেষ করে বর্তমান সময়টা উচ্চশিক্ষার আমূল পরিবর্তনের এক অবারিত সুযোগ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা যথেষ্ট। এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার জন্য পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এখন সংস্কারের আলোচনা হচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় আমাদের সংস্কার বা পরিবর্তনটা যেন কথার কথা না হয়। উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই অগ্রসর হতে হবে। তবে শিক্ষা বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এবং সাদামাটা চোখেও কিছু সংকট দেখছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এতদিন ধরে যেই অপরাজনীতির চর্চা চলে আসছিল, সে কারণে উপাচার্য ও শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ হয়েছে ব্যাপকভাবে। লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি ও শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংসের এ রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। এ রাজনীতির কারণে কলমের পরিবর্তে অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখেছি ক্যাম্পাসে। এক শিক্ষার্থী অপর শিক্ষার্থীর প্রাণ হরণ করেছে তথাকথিত রাজনীতির কারণেই। ভারতের আইআইটিগুলোতে এ ধরনের লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির অস্তিত্ব নেই বলেই আমরা জানি। ভারত এটি নিশ্চিত করেই তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্বমানে উঠিয়েছে। সেজন্য আমাদের রাজনীতিকদের দায়িত্ব অনেক। তারা যদি চান, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি চলবে না, রাজনীতির প্রভাব খাটিয়ে যোগ্যদের পরিবর্তে অযোগ্যরা শিক্ষক হবেন না, রাজনৈতিক দলের পরিবর্তে হলগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রভাব থাকবে, তবেই শিক্ষার মান ফেরানো সম্ভব হবে। অর্থাৎ প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয়করণমুক্ত করতে হবে। আর দ্বিতীয়টা হবে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মান ফেরানোর পদক্ষেপ নেওয়া। বর্তমানে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই উপাচার্যসহ নতুন প্রশাসক নিয়োগ পেয়েছেন। তারাও চাইলে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভাবতে এবং বিশ্বমানে উন্নয়নের পদক্ষেপ নিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন।
ভারতের সঙ্গে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইটাই দিন শেষে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। সেজন্যই শিক্ষা নিয়ে ভাবা দরকার। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিবেশীর সঙ্গে আমরা তখনই মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারব- যখন অভ্যন্তরীণভাবে আমরা শক্তিশালী হব। আমরা যখন মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারব, যখন অর্থনীতি শক্তিশালী হবে, যখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যথাযথ হবে, যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মানুষের মধ্যে সংহতি থাকবে এবং যখন নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্য মানুষ তৈরি হবে- তখন অন্যরা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে সাহস করবে না। আর উচ্চশিক্ষার মানের বিষয়টি আমাদের নিজেদের জন্যই জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
"