ভারতীয় মিডিয়ার দায়িত্বহীনতা
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ এবং নিন্দনীয়। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ভারতের অন্তত ৪৯টি সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে একের পর এক ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে। এ ধরনের গুজব কেবল সংবাদপত্রের নৈতিকতা ও পেশাদারিত্বকে কলঙ্কিত করছে না, দুদেশের সম্পর্কের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ভারতীয় গণমাধ্যমের একাংশের অপপ্রচার অশুভ উদ্দেশ্যেই করা হচ্ছে। প্রকৃত তথ্য যাচাই না করে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অসত্য খবর পরিবেশন যে সাংবাদিকতার বড় ধরনের ব্যর্থতা, তা এ ঘটনাগুলো আবারো প্রমাণ করেছে। গণমাধ্যমের নৈতিক দায়িত্ব হলো সত্য প্রকাশ করা, বিভ্রান্তি ছড়ানো নয়। কিন্তু রিপাবলিক বাংলা, হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ, লাইভ মিন্টসহ অনেক শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম বারবার ভুয়া সংবাদ প্রকাশ করে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এ ধরনের ভুয়া সংবাদের কিছু উদাহরণ দৃষ্টিকটু এবং নীতিবহির্ভূত। যেমন- শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তার নামে ভুয়া খোলা চিঠি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার মিথ্যা খবর, কিংবা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ভিত্তিহীন দাবি- এসবই পরিকল্পিত বিভ্রান্তি ছড়ানোর অংশ। গুজবের এ ঢেউ দুদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করছে এবং আস্থার সংকট বাড়াচ্ছে। গণমাধ্যমের এ দায়িত্বহীন আচরণ শুধু বাংলাদেশকেই নয়, ভারতকেও কলঙ্কিত করছে। গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিজেদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং সাংবাদিকতার নৈতিকতা থেকে সরে যাচ্ছে। এমনকি এ গুজব ছড়ানোর পেছনে কোনো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা কাজ করছে কি না, সে প্রশ্নও উঠছে। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ভারতের একটি অংশের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত বলে বহুবার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এমন অবৈধ হস্তক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতকে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, শান্তি এবং গণতন্ত্রকে সমর্থন করা উচিত। কিন্তু তার বদলে অপপ্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার প্রয়াস নিন্দনীয়। ভারতীয় গণমাধ্যমের এ দায়িত্বহীন আচরণ ঠেকাতে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সাংবাদিকদের অবশ্যই তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের নীতি মেনে চলতে হবে। ‘গুজব’ শব্দটি যে সাংবাদিকতার মানদণ্ডের অপমান, তা তাদের মনে রাখতে হবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত কূটনৈতিক পর্যায়ে এ বিষয়টি উত্থাপন করা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
ভারতীয় গণমাধ্যমের এমন একতরফা মিথ্যা প্রচারণা শুধু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ বাড়িয়ে তুলছে না, বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেও চরমভাবে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। গুজব ছড়িয়ে জনগণের মধ্যে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে উত্তেজনা সৃষ্টি করাও একধরনের কৌশলী রাজনৈতিক খেল। এ ধরনের অপপ্রচার কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংকটকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টায় লিপ্ত একটি পক্ষ। দুদেশের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও বন্ধুত্ব বজায় রাখতে হলে দায়িত্বশীল ও পেশাদার সাংবাদিকতার চর্চা অপরিহার্য। ভারতের গণমাধ্যমগুলোকে এ ব্যাপারে আরো সতর্ক হতে হবে এবং সত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। অন্যথায় মিথ্যা তথ্যের এ নির্মম ছোবল একদিন আঞ্চলিক শান্তি ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করবে।
দুদেশের সম্পর্কের ভিত্তি হওয়া উচিত পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস এবং সত্য। একের পর এক ভুয়া খবরের চর্চা সেই ভিত্তিকে দুর্বল করছে। ভারতের সাংবাদিক সমাজের উচিত এ অপসংস্কৃতি বন্ধ করা এবং সংবাদমাধ্যমের পবিত্র দায়িত্বে ফিরে আসা। অন্যথায় এ ধরনের গুজব দুদেশের মধ্যকার সুসম্পর্কে চিড় ধরাবে, যা কখনোই কাম্য নয়। বাংলাদেশের জনগণ এবং সরকারকে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচারের বিরুদ্ধে সচেতন থাকতে হবে। গুজবের জবাব দিতে হবে দৃঢ় সত্য দিয়ে। কারণ সত্যের সামনে মিথ্যা টেকে না, আর দায়িত্বহীন অপপ্রচার বেশিদিন স্থায়ী হয় না।
"