হৃদয় পান্ডে

  ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

মুক্তমত

দলীয় আনুগত্যে হারাচ্ছে শিক্ষার উদ্দেশ্য

শিক্ষা হলো একটি সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শুধু জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে না, বরং নৈতিকতা, মানবিকতা এবং স্বাধীন চিন্তার বীজ বপন করে। শিক্ষক এ প্রক্রিয়ার কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিনি জাতি গঠনের কারিগর। কিন্তু যখন শিক্ষকরা দলীয় আনুগত্যে আবদ্ধ হন তখন তাদের ভূমিকা সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এটি শিক্ষার পবিত্র উদ্দেশ্যকে বিকৃত করে এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নির্মাণে এক গভীর সংকট তৈরি করে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দলীয় আনুগত্য শিক্ষাব্যবস্থার একটি অপ্রকাশিত অথচ প্রভাবশালী সমস্যা। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক দখলদারিত্ব এবং প্রভাব বিস্তারের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। শিক্ষাঙ্গন হওয়া উচিত ছিল মুক্তচিন্তা এবং জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র, তা এখন প্রায়শই দলীয় প্রভাবের বলয়ে আবদ্ধ। দলীয় আনুগত্য কেবল শিক্ষকের নৈতিকতা নয়, বরং শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোকেও আঘাত করছে।

শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মুক্ত চিন্তা এবং যুক্তিবাদী মনোভাব তৈরি করা। কিন্তু দলীয় আনুগত্যের কারণে শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়শই পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে। একজন শিক্ষক যদি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের পক্ষে কাজ করেন, তবে তার শিক্ষাদানেও সেই পক্ষপাত প্রতিফলিত হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে চিন্তা করার পরিবর্তে নির্ধারিত মতাদর্শের সীমায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের মননশীল বিকাশের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করে। দলীয় আনুগত্যের ফলে শিক্ষকদের পেশাগত জীবনে একধরনের অবক্ষয় দেখা দেয়। শিক্ষকতার মতো মহান পেশা তখন আর আদর্শ এবং মানবিকতার প্রতীক হয়ে থাকে না। বরং তা একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়। একজন শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব হলো জ্ঞানের আলো ছড়ানো এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো। কিন্তু দলীয় আনুগত্যে আবদ্ধ শিক্ষকরা নিজেদের এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে ব্যর্থ হন।

শিক্ষাঙ্গনে দলীয় আনুগত্যের আরেকটি বড় সমস্যা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কাঠামো। নিয়োগ, পদোন্নতি, এবং অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় দলীয় আনুগত্যকে মেধা ও যোগ্যতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর ফলে একদিকে যেমন যোগ্য এবং দক্ষ ব্যক্তিরা অবমূল্যায়িত হন, অন্যদিকে অনুপোযুক্ত এবং অযোগ্য ব্যক্তিরা শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এটি শিক্ষার মান হ্রাস করে এবং পুরো ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলে। দলীয় আনুগত্য শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বিভাজন সৃষ্টি করে। শিক্ষার্থীরা দলীয় বিভক্তির শিকার হয়ে নিজেদের শিক্ষার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেখানে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং একতাবোধ গড়ে ওঠা উচিত, সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব তাদের মধ্যে বিদ্বেষ এবং প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়। এটি শিক্ষাঙ্গনের শান্তি নষ্ট করে এবং শিক্ষার পরিবেশকে কলুষিত করে।

সমাধান হিসেবে শিক্ষাঙ্গনে দলীয় প্রভাব হ্রাস এবং শিক্ষার পরিবেশ পুনরুদ্ধারের জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, শিক্ষকের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। যোগ্যতা এবং মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি দিতে হবে, যাতে শিক্ষকরা দলীয় আনুগত্যের চাপে পড়ে কাজ না করেন।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের জন্য একটি নিরপেক্ষ এবং পেশাদার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তাদের রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত রাখতে হবে এবং তাদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

তৃতীয়ত, শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করা উচিত, কিন্তু তা যেন দলীয় বিভক্তির জন্ম না দেয়। শিক্ষার্থীদের উচিত স্বাধীনভাবে চিন্তা করা এবং নিজেদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পাওয়া। এর জন্য শিক্ষাঙ্গনে মুক্ত চিন্তা এবং মুক্ত আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

চতুর্থত, শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য যথাযথভাবে পালন হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো একটি জাতিকে আলোকিত করা। শিক্ষকের ভূমিকা হলো সেই আলো বহন করা। কিন্তু যদি শিক্ষক নিজেই রাজনৈতিক স্বার্থের হাতিয়ারে পরিণত হন, তবে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। আমাদের সমাজে দলীয় আনুগত্য শিক্ষার পরিবেশকে নষ্ট করছে এবং একটি প্রজন্মকে সংকীর্ণ চিন্তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

শিক্ষাকে রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখতে হলে আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। শিক্ষকরা যদি দলীয় আনুগত্য থেকে বেরিয়ে এসে তাদের প্রকৃত দায়িত্ব পালন করেন, তবে শিক্ষার পরিবেশ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো মুক্ত চিন্তা, নৈতিকতা, এবং মানবিকতার বিকাশ। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য দলীয় আনুগত্যের শৃঙ্খল থেকে শিক্ষকদের মুক্ত করা অপরিহার্য।

লেখক : শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close