মো. তাহমিদ রহমান

  ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

বিশ্লেষণ

প্রযুক্তি বিপ্লবে অন্যতম হাতিয়ার গ্রাফিন

আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি;

এত নগণ্য হয়তো চোখেও পড়ি না:

তবু জেনো

মুখে আমার উশখুশ করছে বারুদ-

বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;

আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।

মনে আছে সেদিন হুলস্থুল বেঁধেছিল?

ঘরের কোণে জ্বলে উঠেছিল আগুন-

আমাকে অবজ্ঞা করো না- নিভিয়ে ছুড়ে ফেলায়!

কত ঘরকে দিয়েছি পুড়িয়ে,

কত প্রাসাদকে করেছি ধূলিসাৎ;

আমি একাই ছোট্ট একটা দেশলাই কাঠি।

এমনি বহু নগর, বহু রাজ্যকে দিতে পারি ছারখার করে।

তবুও অবজ্ঞা করবে আমাদের?

মনে নেই? এই সেদিন-

আমরা সবাই জ্বলে উঠেছিলাম একই বাক্সে;

চমকে উঠেছিলে-

আমরা শুনেছিলাম তোমাদের বিবর্ণ মুখের আর্তনাদ!

আমাদের কী অসীম শক্তি

তা তো অনুভব করেছ বারংবার;

তবুও কেন বোঝো না,

আমরা বন্দি থাকব না তোমাদের পকেটে পকেটে,

আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব-

শহরে, গঞ্জে, গ্রামে-দিগন্ত থেকে দিগন্তে।

আমরা বারবার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায়

তা তো তোমরা জানোই।

কিন্তু তোমরা তো জানো না?

কবে আমরা জ্বলে উঠব-

সবাই শেষবারের মতো!

পঙক্তিগুলো কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের দেশলাই কাঠি কবিতার। কবিতাটি মোটামুটি আমাদের অনেকেরই জানা। এই দেশলাই কাঠির মতো অত্যন্ত সাধারণ পদার্থ হলো গ্রাফাইট। এটি কার্বনের একটি রূপভেদ। কার্বনের আরেকটি রূপভেদ হলো হিরা। হিরা যেমন অত্যন্ত মূল্যবান ধাতু, গ্রাফাইট আবার ততটাই মূল্যহীন ধাতু। কিন্তু সাধারণ, মূল্যহীন গ্রাফাইট থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এমনই এক পদার্থ যা বর্তমান বিজ্ঞান প্রযুক্তির জগতে একটা বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। জার্মান রসায়নবিদ হানজ পিটার বুম গ্রাফাইট থেকে উৎপন্ন এই পদার্থটির নামকরণ করেন গ্রাফিন। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে, ইংল্যান্ডের বোরোডেল উপত্যকায় রাখালেরা প্রথম গ্রাফাইটের সন্ধান পায়। এটি হাতে ধরলেই হাত কালো হয়ে যেত কিন্তু পাথরের ওপর খুব ভালোভাবে দাগ কাটা যেত। তখন রাখালেরা ভেড়া গোনার কাজে এটিকে ব্যবহার করত। তারপর আস্তে আস্তে গ্রাফাইট পেন্সিলের মাধ্যমে মানব সমাজে জ্ঞানের লৈখিক প্রকাশে প্রকাশিত হলো।

ঠিক তেমনি গ্রাফিন আবিষ্কারের পিছনে একটা মজাদার গল্প লুকিয়ে আছে। ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই প্রথিতযশা বিজ্ঞানী আঁন্দ্রে গেইম এবং কনস্টানটিন নভোসেলভ প্রায় প্রতি শুক্রবার রাতে এমন কিছু বিষয়ের ওপর গবেষণা নিয়ে আলোচনা করতেন যা তাদের দৈনন্দিন গবেষণার কাজের সঙ্গে কোনোই সম্পর্ক নেই। এইরকম এক সন্ধ্যায় কিছু একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে করতে যতবার পেন্সিল দিয়ে কাগজে কিছু লিখতে যাচ্ছিলেন তখনই সেটা বারবার করে ভেঙে যাচ্ছিল। অবশেষে হতাশ হয়ে আলোচনা বন্ধ করে ভাঙা পেন্সিলের টুকরোগুলো পাউডারের মতো গুঁড়ো করে স্বচ্ছ সেলোফেন স্কচ টেপের মধ্যে রেখে একের পর এক ভাঁজ করতে লাগলেন। তার ফলে গ্রাফাইটের পাউডার থেকে কার্বনের কিছু স্তর (ফ্লেকস) আলাদা করতে সক্ষম হলেন। লক্ষ্য করলেন প্রথমদিকে স্তরগুলোর থেকে পরের দিকের স্তরগুলো ক্রমশ পাতলা হতে শুরু হয়েছে। এইভাবে এমন একটা স্তর আলাদা করে ফেললেন যেটি মাত্র একটি কার্বন পরমাণুর সমান পুরু। এভাবেই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আঁন্দ্রে গেইম এবং কনস্টানটিন নভোসেলভ গ্রাফিন আবিষ্কার করে ফেললেন। এরপরই এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ দিয়ে শুরু হলো বিজ্ঞানের নতুন অগ্রযাত্রা।

গ্রাফিন মূলত কার্বনের একটি দ্বিমাত্রিক রূপ। একটি ষড়ভুজাকার কাঠামোতে গ্রাফিনের পরমাণুসমূহ সাজানো থাকে। কার্বনের এই রূপভেদটি মানুষের চুলের ১০ লাখ ভাগের এক ভাগের মতো পাতলা, স্বচ্ছ আর নমনীয়। কিন্তু এর শক্তি স্টিলের থেকে ২০০ গুণ বেশি। এতই অভেদ্য যে বিশ্বের সব থেকে ছোট উপাদান হিলিয়াম কণাও একে ভেদ করে যেতে পারে না। তামার থেকে অনেকগুণ বেশি বিদ্যুৎ পরিবহন করার ক্ষমতা আবার হীরের থেকেও বেশি তাপ সঞ্চালন করার ক্ষমতা গ্রাফিনের। বিদ্যুৎ অপরিবাহী হিসেবে এতদিন জেনে এসেছি যাকে, সেই প্লাস্টিকের সঙ্গে যদি এক শতাংশের মতন গ্রাফিন মিশিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে প্লাস্টিকও হয়ে উঠবে বিদ্যুৎ পরিবাহী। সাধারণত উত্তপ্ত করলে যে কোনো উপাদান আয়তনে বৃদ্ধি পায় আর ঠান্ডায় আয়তন হ্রাস পায়। গ্রাফিনের ক্ষেত্রে ঘটনাটি সম্পূর্ণ উল্টো। উত্তপ্ত করলে আয়তন হ্রাস পায় আর ঠান্ডা করলে আয়তন বৃদ্ধি পায়। পানির মধ্যে ডুবিয়ে রাখলে পচে নষ্ট হয়ে যায় না আবার মরিচাও ধরে না। এতসব অদ্ভুত গুণের অধিকারী, ন্যানোলেভেলের এই গ্রাফিন পদার্থটি। এটিকে মাটির মধ্যে পুঁতে দিলে ধীরে ধীরে মাটির সঙ্গে মিশে বিলিন হয়ে যায় অর্থাৎ কোনো প্রকার পরিবেশ দূষণ করে না। বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন, তথ্যপ্রযুক্তি ও চিকিৎসাপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণায়ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে গ্রাফিন। গ্রাফিন ও গ্রাফিনের মতো স্বজাতিদের ওপর গবেষণা করার জন্যে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ন্যাশনাল গ্রাফিন ইনস্টিটিউট।

ইতোমধ্যে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা গ্রাফিন দিয়ে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম ট্রানজিস্টার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। মাইক্রোচিপস তৈরি করতে সিলিকনের বদলে গ্রাফিনের ব্যবহার শুরু হয়েছে। শুধু ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারই নয়, সমগ্র বিশ্ব এখন গ্রাফিন নিয়ে মাতোয়ারা। ফলশ্রুতিতে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে বিজ্ঞানী আঁন্দ্রে গেইম এবং কনস্টানটিন নভোসেলভ পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। গ্রাফিন ন্যানোপাটিকেল চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ক্যানসার কোষের ধ্বংস থেকে শুরু করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে যেখানে সাধারণভাবে অপারেশন অসম্ভব- সেসব জায়গায় গ্রাফিন ন্যানোপার্টিকেলের অবাধে যাতায়াত করছে। গ্রাফিন যেহেতু খুব পাতলা আর কার্বন দিয়ে তৈরি, তাই মানবদেহের টিস্যু প্রযুক্তিতে কাজে লাগানো হচ্ছে। গ্রাফিন অক্সাইড মেমব্রেন ফিল্টারের সাহায্যে খুব সহজে যেকোনো ধরনের নোংরা জলকে পরিশোধন করে পানীয় জলের উপযোগী করা যাচ্ছে। জলের মধ্যে কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকলে তা সহজেই পৃথকিকরণ করা সম্ভব হচ্ছে। সমুদ্রের জলে ছড়িয়ে থাকা তেল আলাদা করা সম্ভব হচ্ছে। টেকসই ও হালকা হওয়ায় খেলাধুলাসামগ্রী, নির্মাণসামগ্রী, পরিবহনশিল্প এবং ইলেকট্রিক্যাল গ্যাজেটসমূহে ব্যাপক হারে গ্রাফিনের ব্যবহার শুরু হয়েছে।

বিশ্বখ্যাত কম্পিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আইবিএম সিলিকন ট্রানজিস্টারের বদলে গ্রাফিন ট্রানজিস্টারের উৎপাদন শুরু করেছে। গ্রাফিন তাপ সুপরিবাহী বলে সহজে তাপ ছেড়ে দিতে পারে। ফলে দীর্ঘক্ষণ ব্যবহারের পরও কম্পিউটার ঠান্ডা থাকবে। অত্যন্ত স্বচ্ছ হওয়ায় গ্রাফিন ভিডিওচিত্র প্রদর্শনের মূল উপাদান হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। সূক্ষ্মতার কারণে স্বাভাবিকের তুলনায় এর রেজ্যুলেশন অনেক বেশি এবং ব্যবহার করা যাচ্ছে অনেক সহজে। এ সব সুবিধার জন্য স্যামসাং বাজারে নিয়ে আসছে প্রিন্টেড গ্রাফিন ইলেকট্রোড, যা মোবাইলের টাচ স্ক্রিনে ব্যবহৃত হবে। যুক্তরাজ্যের প্রযুক্তি-উদ্যোক্তা সাইমন থমাস মাইক্রোচিপ তৈরির একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। সেখানে বৈদ্যুতিক গাড়ির সেন্সরসহ বিভিন্ন যন্ত্র তৈরিতে গ্রাফিন ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, নতুন প্রজন্মের এমআরআই স্ক্যানারের চৌম্বকীয় সেন্সর আর ড্রোন তৈরিতেও গ্রাফিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া গ্রাফিনের যৌগ গ্রাফিন অক্সাইড একটি অ্যান্টিব্যাক্টোরিয়াল। তাই চীনে খাবার সংরক্ষণে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। গ্রাফিন এতোটাই পাতলা যে এটা মাত্র ২.৩ শতাংশ আলো শোষণ করে। এত পাতলা, এত স্বচ্ছ, অথচ গ্রাফিন ইস্পাতের চেয়েও কমপক্ষে একশগুণ শক্ত। গ্রাফিনের ভার সইবার ক্ষমতা ৪২.০ নিউটন/মিটার, অথচ ইস্পাতের ভার সইবার ক্ষমতা মাত্র ০.৪০ নিউটন/মিটার। দৃঢ়তা ও স্বচ্ছতার কারণে গ্রাফিন থেকে তৈরি করা হচ্ছে মহাকাশচারীদের উপযোগী নতুন ধরনের পোশাক ও অন্য উপকরণ।

বর্তমানে দুনিয়াজুড়ে সেমিকন্ডাক্টরের বাজার ৫০ হাজার কোটি ডলারের যা ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তাই বিশ্ববাজারে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে চীন গ্রাফিননির্ভর পণ্য তৈরির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। চীনে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান গ্রাফিননির্ভর মাইক্রোচিপ উৎপাদনে কাজ করছে। প্রযুক্তি বিপ্লবের নতুন শীতল যুদ্ধে অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠছে গ্রাফিন। সেমিকন্ডাক্টর দুনিয়ায় দীর্ঘদিন রাজত্ব করে আসা সিলিকনের বিদায় ঘণ্টা বাজার সময় মনে হয় শুরু হয়ে গেছে। এবার সিলিকনকে খুব শিগগিরই রাজ্য আর রাজত্ব গ্রাফিনের হাতে তুলে দিতে হবে। প্রযুক্তিতে মানবজাতির অগ্রগতির মাইলফলকে গ্রাফিন হলো কল্পনাবিজ্ঞানের বাস্তব রূপকার।

লেখক : প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি)

নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close