শেখ রোকন

  ০৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

মতামত

পতাকা পোড়ানো বা পাড়ানোয় কার লাভ?

যে দেশেরই হোক, জাতীয় পতাকার অবমাননা মানে দুশমনি দাওয়াত দিয়ে আনা। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু নাগরিক সেই অবিমৃষ্যকারিতাই করে চলেছে কয়েক দিন ধরে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের যে অবনতি ঘটেছিল; সামাজিক মাধ্যমে পরস্পরবিরোধী যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল; সেটা এখন উভয়ের জাতীয় পতাকা পোড়ানো বা পাড়ানোতে এসে ঠেকেছে।

যে দেশেরই হোক, জাতীয় পতাকা বা জাতীয় সংগীত মানে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আবেগ ও অনুভূতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষত যাদের জন্ম কোনো দেশের স্বাধীনতার পর, তারা শৈশব থেকেই জাতীয় সংগীত গেয়ে বা জাতীয় পতাকাকে অভিবাদন জানিয়ে বড় হতে হতে সেগুলোকে অবচেতন অস্তিত্বের অংশ করে ফেলে। তাদের কাছে জাতীয় পতাকা মানে নিছক বস্ত্রখণ্ড নয়; জাতীয় সংগীত মানেও সুরধ্বনিমাত্র নয়।

মনে আছে, ২০১৬ সালে ভারতের গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমসে ভারোত্তোলনে স্বর্ণপদক জয়ের পর বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজতে শুনে ও জাতীয় পতাকা উঠতে দেখে মাবিয়া আক্তার সীমান্ত থরথর আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। চোখ ফেটে বের হয়েছিল কান্না। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত সেই দৃশ্য বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষেরও চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিল। ভারতের পতাকা নিয়েও সে দেশের নাগরিকদের আবেগ নিশ্চয় এর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। অনলাইনে সার্চ দিলেই মাবিয়া আক্তারের মতো অনেককে পাওয়া যাবে।

সত্য, পতাকা অবমাননার সাম্প্রতিক সূত্রপাত ঘটেছিল ভারতেই। সেপ্টেম্বরে কানপুরে বাংলাদেশ-ভারত টেস্ট ম্যাচ চলাকালে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের বাইরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল ‘হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে’ বাংলাদেশি পতাকা পোড়ায়। (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। গত বৃহস্পতিবারও ‘বঙ্গীয় হিন্দু জাগরণ মঞ্চ’ বাংলাদেশি পতাকা পোড়ায় কলকাতাস্থ উপহাইকমিশনের সামনে; চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে। সম্ভবত এর প্রতিক্রিয়ায়, একই দিনে বুয়েটের প্রবেশপথে ভারতীয় পতাকা আঁকা হয়। সেই পতাকা পাড়ায়ে বা মাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হয়ে যায়।

সত্য, পতাকা পোড়ানো দেখে আমরা যতটা অভ্যস্ত, পাড়ানো দেখে ততটা নই। ঢাকাতেও প্রায়শ বাম বা ডানপন্থি বিভিন্ন গোষ্ঠী মার্কিন বা ইসরায়েলি পতাকা পোড়ায়। ভারত-পাকিস্তানেও পরস্পরের পতাকা পোড়ানো প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক। কিন্তু পতাকা পাড়ানোর দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। সাম্প্রতিক পাল্টাপাল্টি আগে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেও পতাকা পোড়ানোর দৃশ্য খুব বেশি চোখে পড়েনি। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ বা ভারতের জাতীয় পতাকা পোড়ানো ও পাড়ানোর এই অবিমৃষ্যকারিতায় কার লাভ?

আসলে বাংলাদেশ ও ভারত- উভয়েরই ক্ষতি। যে পতাকার মর্যাদা রক্ষায় যুযুধান দুই পক্ষ, সেই পতাকারই অবমাননা ছাড়া আখেরে কিছু মিলছে না। যেমন ভারতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা পোড়ানো হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পথে ভারতীয় পতাকা পাড়ানোর আয়োজন হয়েছে। পাল্টা দেখা যাচ্ছে, বৈশ্বিক ই-কমার্স কোম্পানি আমাজনে পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশের পতাকা অঙ্কিত ফ্লোর ম্যাট। স্পষ্টত এর পেছনে রয়েছে ভারতীয় কোনো অতিউৎসাহী। এখন সামাজিক মাধ্যমে কেউ কেউ বলছেন ভারতীয় পতাকা দিয়ে টিস্যু তৈরি করে বাজারে ছাড়ার কথা। তার মানে, নিজের পতাকার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে যখন অন্যের পতাকার অবমাননা করছি, তখন নিজের পতাকারই আরো বেশি মর্যাদাহানির ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে।

বলা বাহুল্য, জাতীয়তাবাদী অনুরাগ বা বিরাগ কেবল প্রতীকী পদক্ষেপে সীমাবদ্ধ থাকে না। পরস্পরের জাতীয় পতাকা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিকদের যুযুধান পরিস্থিতির প্রভাব দুই দেশের আর্থ-সামাজিক সম্পর্কেও পড়ছে। সেখানেও ক্ষতি কিন্তু দুই পক্ষেরই। ইতোমধ্যে কোনো কোনো ভারতীয় হাসপাতাল ও কয়েকজন চিকিৎসক ঘোষণা দিয়েছেন- তারা বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা করবেন না। দেশটির হাসপাতাল বা চিকিৎসকদের মধ্যে এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়লে যে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি উন্নত ও সঠিকতর চিকিৎসার জন্য ভারতে যান, তারা নিশ্চয় বিপাকে এমনকি বিপদে পড়বেন। কিন্তু আখেরে ভারতীয় স্বাস্থ্যশিল্পেরই ক্ষতি। কারণ সেখানে বাংলাদেশি চিকিৎসাপ্রার্থীর হার এত বেশি যে, তামিলনাড়ুর মতো অ-বাংলাভাষী অঞ্চলের অনেক হাসপাতালে বাংলা ভাষায় নির্দেশনা বা দোভাষীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশি চিকিৎসাপ্রার্থীদের নিশানা করে গড়ে উঠেছে পরিবহন, হোটেল, ওষুধ ব্যবসা, শপিংমল। যদি বাংলাদেশি রোগীরা ভারত যাওয়া বন্ধ করেন, তাহলে এসব ব্যবসা লাটে উঠতে বাধ্য।

ভারতের সরকারি তথ্য অনুযায়ীই, দেশটিতে সবচেয়ে বেশি পর্যটক যায় বাংলাদেশ থেকে। তারা চিকিৎসা, বেড়ানো বা পড়াশোনার জন্য গিয়ে ভারতীয় অর্থনীতিতে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। যদি বাংলাদেশি পর্যটক বন্ধ হয়, তাহলে ভারতীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি কী দাঁড়াতে পারে, এর খণ্ডচিত্র উঠে এসেছে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে। ‘বাংলাদেশের পর্যটক না আসায় ধুঁকছে কলকাতার যেসব অঞ্চল’ শিরোনামে ৮ সেপ্টেম্বর (২০২৪) প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশি পর্যটকের জন্য ভারতীয় ভিসা বন্ধ হওয়ায় মাত্র এক মাসেই সেখানকার হোটেল, হাসাপাতাল ও শপিংমলের ‘সব ব্যবসায়ীই মার খাচ্ছে’।

গত কয়েক মাসে আমার পরিচিত কয়েকজনকে দেখেছি ভারতীয় ভিসা বন্ধ থাকায় চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে যেতে। যেখানে একই বা কম খরচে সমান বা ভালো চিকিৎসা মিলছে বলে তাদের অভিমত। যদি পতাকা পোড়ানো ও পাড়ানো নিয়ে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে, তাহলে বাংলাদেশি চিকিৎসাপ্রার্থীর বড় অংশ থাইল্যান্ডমুখী হলে বাংলাদেশের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল ভারতীয় স্বাস্থ্যশিল্প অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এটা ঠিক, থাইল্যান্ড যাওয়ার মতো সামর্থ্য বা স্বাচ্ছন্দ্য সবার নেই। ভাষা ও সাংস্কৃতিক কারণে ‘প্রতিবেশী’ ভারতে তারা অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কিন্তু নিরুপায় হলে উপায় কী?

মনে আছে, একসময় বাংলাদেশি গরুর বাজার ছিল অতিমাত্রায় ভারতনির্ভর। কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় এসে ২০১৪ সালে সীমান্তে কড়াকড়ির মাধ্যমে ‘গরু পাচার’ বন্ধ করেছিল।

প্রথমবার তাতে, বিশেষত কোরবানির ঈদের সময় বাংলাদেশিরা বিপাকে পড়লেও গত এক দশকে সেটা সামলে নিয়েছে। গরু উৎপাদনে বাংলাদেশ এতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে যে, এখন বরং ভারতীয় গরু যাতে চোরাচালান না হয়ে আসে, সে জন্যই উৎকণ্ঠা থাকে।

চলতি বছর সংবাদপত্রের একটি প্রতিবেদনের অংশবিশেষ ছিল এমন, ‘কোনো অবস্থাতেই সীমান্ত দিয়ে গরু আসবে না বলে জানিয়েছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী। বাস্তবে দেশের বিভিন্ন সীমান্তে কোরবানির ঈদ ঘিরে চোরাকারবারিরা তৎপর হয়ে উঠেছে। কয়েক বছর ধরে দেশি পশু দিয়েই কোরবানি হচ্ছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ বছর ১ কোটি ১০ লাখের বিপরীতে কোরবানির জন্য ১ কোটি ৩০ লাখ পশু প্রস্তুত আছে। চাহিদার তুলনায় ২০ লাখ পশু বেশি আছে।’ (সমকাল, ১৫ মে ২০২৪)।

এখন, গরু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার উদাহরণ সামনে রেখে যদি বাংলাদেশেই নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। একই কথা বলা চলে চাল বা পেঁয়াজের মতো কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে পারলে কৃষক এ দুই পণ্যের ভালো দাম পাবে এবং উৎপাদন বাড়িয়ে দেবে। আর দেশেই যদি উন্নত ও সাশ্রয়ী উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে বাংলাদেশি ছাত্ররা কেন ভারতে পড়তে যাবে?

কথা হচ্ছে, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ভারতীয় পতাকা অবমাননা না করেও সম্ভব। যেমন ভারতের পক্ষেও সম্ভব বাংলাদেশের পতাকা অবমাননা না করেই কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ জানানো। সেটাই হওয়া উচিত; প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উভয়েরই যে উন্নয়ন সম্ভব, সেটা দেখিয়েছে ইউরোপ বা আসিয়ান দেশগুলো। অভিন্ন ইতিহাস, ভূগোল, ভাষা ও খাদ্যাভ্যাসের অংশ বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য সেটা আরো সহজ। প্রয়োজন কেবল পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সম্পর্ক।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অমীমাংসিত অনেক ইস্যুই রয়েছে- অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি। এসব নিয়ে সীমান্তের দুই পাশেরই সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ওঠানো খুব জরুরি। কিন্তু প্রকৃত অমীমাংসিত ইস্যুগুলো বাদ রেখে পতাকা অবমাননায় মেতে ওঠায় আর যা-ই থাকুক, কোনো পক্ষের জন্য লাভ নেই।

লেখক : নদী-গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close