মো. হাসনাইন রিজেন
মুক্তমত
শান্তি প্রতিষ্ঠায় ঐক্যের গুরুত্ব
শান্তি এবং ঐক্য সমাজ গঠনের দুটি অপরিহার্য ভিত্তি। এগুলোর অভাব কেবল সংঘাতের সৃষ্টি করে না, বরং ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রগতিকে ব্যাহত করে। বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক, বহুধর্মীয় এবং বহুসংস্কৃতির দেশ। এখানে সহমর্মিতা, সহযোগিতা এবং সহাবস্থান কেবল সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ নয়; এটি আমাদের জাতীয় পরিচয়েরও অন্যতম ভিত্তি।
বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাব আমরা আমাদের ভাষার জন্য কি রকম ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি ভাষা, সংস্কৃতি এবং মুক্তির স্বপ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রে লড়াই করেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সেই ঐক্যের শক্তিতে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ঠিক তেমনি ২০২৪ সালে এসেও আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সারা দিয়ে দল মত নির্বিশেষে একটি স্বৈরশাসককে হঠাতে পরেছি। তবে কিছু নেতিবাচক প্রবণতাও দেখা গেছে, যা আমাদের সমাজে বিভাজন ও সংঘাত সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্তির কারণে সমাজে শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে। ঠিক তেমনি এখনো একটা শক্তি সেই আগের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে আমাদের শান্তি কেড়ে নিতে চাচ্ছে। তাই শান্তির জন্য ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জাতি, ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতি নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে ঐক্য নিশ্চিত হলে, শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। আর এই শান্তি প্রতিষ্ঠায় ঐক্য অপরিহার্য।
সমাজে বৈষম্য ও শোষণ শান্তির প্রধান শত্রু। যখন কিছু মানুষ আর্থিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিকভাবে বঞ্চিত হয়, তখন তাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। সেক্ষেত্রে ঐক্য সমাজের প্রতিটি সদস্যকে সমান অধিকার দেওয়ার প্রচেষ্টা চালায় এবং বৈষম্য দূর করতে সহায়ক। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে, মানুষ একে অপরকে সহযোগিতা করতে এবং সম্মান করতে শিখে, যা বৈষম্য দূরীকরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ঐক্যই শান্তির ভিত্তি। ঐক্য মানুষের মধ্যে মৈত্রী এবং সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটায়। যখন মানুষ একে অপরকে বুঝতে পারে এবং সম্মান করে, তখন সংঘর্ষের সম্ভাবনা কমে যায়। সমাজের সব স্তরের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে, ঐক্যবদ্ধ সমাজে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এটি যেকোনো ধর্ম, জাতি, বা সংস্কৃতির মধ্যে ভেদাভেদ দূর করতে সহায়ক। সুতরাং, বাংলাদেশের মতো একটি বহুত্ববাদী সমাজে ঐক্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে উৎসব এবং সংলাপের আয়োজন করা উচিত। বিভিন্ন খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো এবং ভুয়া খবর প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর মাধ্যমেও সমাজে হতাশা ও সংঘাত এড়ানো সম্ভব। এটি করতে হলে দরিদ্র শ্রেণির উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে। এতে করে বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব কমে আসবে এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে।
শান্তি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক ও মানসিক অবস্থানও বটে। তাই শান্তির জন্য ঐক্য মনোভাবটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে। মানুষকে ছোটবেলা থেকেই সহনশীলতা, সহমর্মিতা, এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা শেখানো উচিত। এটি সমাজের শুদ্ধতা এবং শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে। কারণ সংঘর্ষের সময় সাধারণত একতা ও সহযোগিতার অভাব থাকে। যখন একটি সমাজ বা জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তখন তাদের মধ্যে সংঘর্ষ কমে যায় এবং সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যক্তিগত স্বার্থের পরিবর্তে সমষ্টিগত ভালোর দিকে নজর দিলে, একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হতে পারে।
শান্তির জন্য ঐক্য শুধু একটি স্লোগান নয়; এটি একটি কার্যকর পথও বটে। আমাদের সমাজে ধর্ম, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও আমরা একত্রে বাস করি। এটি আমাদের গর্বের বিষয়। কিন্তু সেই ঐক্য রক্ষা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সচেতন প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সবার মাঝে যদি পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা, সহযোগিতা, এবং শ্রদ্ধার মনোভাব থাকে, তবে সমাজে শান্তি নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে, ঐক্যবদ্ধ হলে আমরা যেকোনো বাধা অতিক্রম করতে পারি। সুতরাং, আমাদের এখনই ঐক্যের মূল্যবোধের চর্চা শুরু করা উচিত, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ তৈরি করা যায়।
লেখক : শিক্ষার্থী, হাটহাজারী সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম
"