ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

  ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

শীতে সাইনোসাইটিসের সমস্যা ও সমাধান

ধীরে ধীরে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে সাইনাসের সমস্যাও। নাক-কানের কিছু সমস্যা শীতকালেই হয়, আর কিছু সমস্যা শীতে বাড়ে। শীত মৌসুমে সর্দি-কাশি-হাঁচি বা নাক বন্ধ হওয়ার সমস্যা হতেই পারে। কারো কারো এমন সমস্যায় পুরো শীতকালটাই ভুগতে হয়। এর কারণ ঠান্ডায় সংবেদনশীলতা বা কোল্ড অ্যালার্জি। আমাদের নাকের চারপাশের অস্থিগুলোর ফাঁকে বাতাসপূর্ণ কুঠুরি থাকে। এগুলোকে বলে সাইনাস। এর কাজ হলো মাথাকে হালকা রাখা, আঘাত থেকে মাথাকে রক্ষা করা, কণ্ঠস্বরকে সুরেলা রাখা, দাঁত ও চোয়াল গঠনে সহায়তা করা। সাইনাসের ভেতরের মিউকাস (তরল) স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিদিন নাসিকাগহ্বর দিয়ে বেরিয়ে যায়। নাকের ভেতর দিয়ে সাইনাসে বাতাস চলাচল করে। এ প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটলে বাতাসের পরিবর্তে সেখানে পানি বা তরল পদার্থ জমা হয়ে প্রদাহ হয়। একে সাইনোসাইটিস বলা হয়।

কেন হয় : নাকে অ্যালার্জির সমস্যা, ভাইরাস সংক্রমণ, মৌসুম পরিবর্তনজনিত সাধারণ ঠান্ডা-সর্দি, নাকের মাঝখানের হাড় বাঁকা হওয়া, নাকের ভেতরে মাংস (টারবিনেট) বৃদ্ধি, পলিপ, টিউমার ইত্যাদি কারণে সাইনোসাইটিস হয়। শীত বা এর শুরুতে অ্যালার্জি, ঠান্ডা ও ইনফ্লুয়েঞ্জা বেশি হয়। যাদের এ সমস্যাগুলো আছে, তাদের ক্ষেত্রে রোগটির প্রকোপ এ সময় বেশি দেখা দেয়। সাইনাস খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। এ সমস্যায় আমরা প্রায় প্রত্যেকেই ভুগি। বিভিন্ন ইনফেকশন, অ্যালার্জি থেকে সাইনাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর ফলে আমরা মাথার যন্ত্রণা, মুখমণ্ডলে যন্ত্রণা, নাক থেকে পানি পড়া এবং নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যায় পড়ি। সাইনাস সাধারণত বায়ুপূর্ণ মিউকাস পর্দায় আবৃত এবং ক্ষুদ্র নালির মাধ্যমে নাসাগহ্বর তথা শ্বাসনালির সঙ্গে যুক্ত থাকে। এসব সাইনাস যদি বাতাসের বদলে তরল পদার্থে পূর্ণ থাকে এবং এই তরল যদি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকে সংক্রমিত হয় তখন সাইনাসের মিউকাস পর্দায় প্রদাহের সৃষ্টি হয়।

সাইনোসাইটিসের প্রকারভেদ : মাথার খুলিতে মুখমণ্ডলীয় অংশে নাসাগহ্বরের দুপাশে অবস্থিত বায়ুপূর্ণ চারজোড়া বিশেষ গহ্বরকে সাইনাস বা প্যারান্যাসাল সাইনাস বলে। এগুলো হলো-

১. ম্যাক্সিলারি সাইনাস : ম্যাক্সিলারি অঞ্চলে গালে অবস্থিত। ২. ফ্রন্টাল সাইনাস : চোখের উপরে অবস্থিত। ৩. এথময়েড সাইনাস : দুচোখের মাঝখানে অবস্থিত। ৪. স্ফেনয়েড সাইনাস : এথময়েড সাইনাসের পেছনে অবস্থিত।

স্থায়িত্বের ওপর ভিত্তি করে সাইনোসাইটিস দুরকম : ১. অ্যাকিউট সাইনোসাইটিস : এর স্থায়িত্ব ৪-৮ সপ্তাহ। ২. ক্রনিক সাইনোসাইটিস : এর স্থায়িত্ব ২ মাসের বেশি সময়।

সাইনাসের লক্ষণ : ১. নাক থেকে হলদে বা সবুজ বর্ণের ঘন তরল বের হয়। এতে পুঁজ বা রক্ত থাকতে পারে। ২. দীর্ঘ ও বিরক্তিকর তীব্র মাথাব্যথা লেগেই থাকে যা সাইনাসের বিভিন্ন অঞ্চলে হতে পারে। ৩. মাথা নাড়াচাড়া করলে, হাঁটলে বা মাথা নিচু করলে ব্যথার তীব্রতা আরো বেড়ে যায়। ৪. জ্বর জ্বর ভাব থাকে, কোনো কিছু ভালো লাগে না বরং অল্পতেই ক্লান্ত লাগে। ৫. নাক বন্ধ থাকে, নিঃশ্বাসের সময় নাক দিয়ে বাজে গন্ধ বের হয়। ৬. মুখমণ্ডল অনুভূতিহীন মনে হয়। ৭. মাথাব্যথার সঙ্গে দাঁত ব্যথাও হতে পারে। ৮. কাশি হয়, রাতে কাশির তীব্রতা বাড়ে, গলা ভেঙে যায়।

জটিলতা : সাইনোসাইটিস সংক্রান্ত জটিলতা কেবল নাসিকাগহ্বর ঘিরেই অবস্থান করে না, বরং সাইনাসগুলোর অবস্থান চোখ ও মস্তিষ্কের মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল অঙ্গের সংলগ্ন হওয়ায় জীবাণুর সংক্রমণ শুধু সাইনাসেই সীমাবদ্ধ না থেকে রক্তবাহিত হয়ে চোখ ও মস্তিষ্কে পৌঁছালে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্কে সংক্রমণের ফলে মাথাব্যথা, দৃষ্টিহীনতা থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। চোখে সংক্রমণের ফলে পেরিঅরবিটাল ও অরবিটাল সেলুলাইটিসসহ আরো অনেক জটিলতা দেখা দিতে পারে।

যা করবেন : ১. যদি সাইনাসের সমস্যা থাকে তবে সর্বদা নিজেকে হাইড্রেটেড রাখুন। এ জন্য প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। দেহে পানির অভাবে সাইনাসের সমস্যাগুলি আরো বেড়ে যায়। ২. চিনি ছাড়া চা পান করুন। এর মাধ্যমে দেহ থেকে মিউকাস বেরিয়ে যায়। ৩. সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে খোলা ময়দানে জগিং করলে সাইনোসাইটিসের প্রবণতা কমে। ৪. খেতে পারেন গরম গরম স্যুপ। ৫. ভিটামিন ‘এ’ জাতীয় খাবার খান। লেবুর রস ও মধু অথবা শুধু এক কাপ গরম পানির সঙ্গে তিন টেবিল চামচ আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে খেলে সাইনাসের চাপ কমে যায়। ৬. হলুদ এবং আদা চা খান। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ মিউকাস কমাতে সহায়তা করে, বন্ধ নাক খোলে। ৭. এক চা চামচ মধুর সঙ্গে আদার রস মিশিয়ে দিনে ২-৩ বার খান। ৮. গরম পানির ভাপ নিন, এটি নাক খুলতে সাহায্য করে। ৯. গোলমরিচ সাইনাসের জন্য খুব উপকারী, এতে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা সর্দি দূর করতে সহায়তা করে। ১০. আপেল সিডার ভিনেগার এবং লেবুর রসও উপকারী। ১১. এ সময় গরম ভাপ নিন। একটি পাত্রে কিছুটা পানি নিয়ে তাতে ৩ ফোঁটা পিপারমিন্ট তেল, ৩ ফোঁটা রোসমেরি তেল, ২ ফোঁটা ইউক্যালিপটাস তেল দিয়ে হালকা তোয়ালে দিয়ে মুখ ঢেকে ভেপার নিন। এটি নাক খুলতে সাহায্য করে। অনেকটা আরাম বোধ করবেন।

যা খাবেন না : ১. আইসক্রিম, পনির এবং দই এবং ঠান্ডা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন। ২. তেলে ভাজা খাবার, ভাত, মসলাদা জাতীয় খাবার ইত্যাদি বাদ দিলে ভালো। ৩. অ্যালকোহল, ক্যাফিন এবং ধূমপান থেকে দূরে থাকুন।

পরিশেষে বলতে চাই, নাকের সমস্যার একটি বড় কারণ দূষণ। ধুলাবালুর কারণে সমস্যা হয়। বাইরের ধুলাবালুকে আমরা হয়তো কিছু করতে পারি না। তবে বাসার যেটা সেটা পরিষ্কার করতে হবে। বাসার ময়লাটাকে আমরা হয়তো এড়িয়ে যাই। দেখবেন কার্পেট রেখে দিয়েছে। সোফার মধ্যে হয়তো ধুলা জমে রয়েছে। ধুলার মধ্যে মাইট থাকে। এগুলো থেকে যে লালা, বর্জ্য বের হয় এর কারণে সমস্যা তৈরি করে। তাই প্রাথমিক চিকিৎসা কিংবা ওষুধের মাধ্যমে প্রতিকার না পেলে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের পরামর্শে পরবর্তী পদক্ষেপ নিন।

লেখক : চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক

প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান , জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close