ড. মাহবুব হাসান
মতামত
স্বাধীন সাংবাদিকতা নিয়ে উদ্বেগ কেন?
এই প্রশ্নটি উঠে আসে তখনই যখন কোনো পত্রিকার ওপর কোনোরকম চাপ আসে। সেই চাপ আসতে পারে সরকারের তরফ থেকে। আসতে পারে কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় গ্রুপের কাছে থেকে। আমরা অতীতে এ রকম চাপ দেখেছি। সংবাদপত্রের ওপর হামলা, ভাঙচুরের ঘটনারও প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমরা। দল-মত নির্বিশেষে যারা কাজ করেন সংবাদপত্রে (এটা মিথ্যা, এখন কোনো মিডিয়ায় নিজেদের লোক ছাড়া কাউকে চাকরি দেওয়া হয় না), ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, তারা কি স্বাধীনভাবে তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পায়? এখন পত্রিকাগুলো এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া মূলত দলচেতনাভুক্ত দাস। বিশেষ করে যে সরকার যখন ক্ষমতায়, তখন তার প্রতি তারা নতশির। পতিত হাসিনা সরকারের প্রতি দেশের সব গণমাধ্যম ছিল কৃতদাসের মতো। তখন কিন্তু কোনো গণমাধ্যম সাংবাদিকতার স্বাধীনতার প্রশ্নটি তোলেনি। কেন হাসিনার অপশাসনকে আপনারা তুলে ধরেননি? নিউজ ছাপানো ও টিভিতে নিউজ ও ভিডিও ক্লিপ প্রচার করতে পারলেই কিন্তু স্বাধীনতা লাভ হয় না। মিডিয়াগুলোর আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাংবাদিকের দৃষ্টিভঙ্গিসহ সময়ের প্রয়োজনকে যিনি বা যারা তুলে ধরতে পারেন, করেন, তাকে প্রাথমিকভাবে স্বাধীন বলা যেতে পারে। তবে প্রকৃত স্বাধীনতা হচ্ছে সাংবাদিকের সৃষ্টিশীল ভাবনা ও চিন্তা করার ক্ষমতা। সেই সঙ্গে তাদের লেখার পারঙ্গমতা, দক্ষতা ও উপস্থাপনার কলাকৌশল। কিন্তু এসব কি আমাদের গণমাধ্যমে আছে?
দুই : আমরা সব কিছুর আগে মিডিয়াগুলোর মালিকদের কথা শুনে আসি। তারা কি বলেন, তার ওপর নজর দিই। গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদ জানিয়ে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করার পক্ষে শক্ত অবস্থানের কথা তুলে ধরেছেন। তারা বলেছেন, দেশবাসীর দীর্ঘদিনের লড়াইটাই ছিল বাকস্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য। দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে হলে অবশ্যই স্বাধীন সাংবাদিকতার নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকে দিতে হবে, সরকারকে দিতে হবে। তাই গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ ও নৈরাজ্য এখনই বন্ধ করতে হবে। (প্র/আ- ২৯ নভেম্বর, ২৪)
প্রথম আলো এবং দ্য ডেইলি স্টারের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) আয়োজন করেছিল একটি মতবিনিময় সভার, গত বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর। তারা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকাংশকেই ওই সভায় আমন্ত্রণ জানান। রাজনৈতিক নেতারা তাদের মতপ্রকাশ করেছেন। বিএনপিসহ সব দলের নেতারাই সংবাদপত্রের ‘স্বাধীন সাংবাদিকতা’র কথা তুলে ধরেছেন। দেশবাসীর দীর্ঘদিনের লড়াইটা ছিল বাকস্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য।
তারা সত্য বলেছেন। বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র একই বৃক্ষের দুই শাখা। রাষ্ট্রে গণতন্ত্র কায়েম থাকলে, যাকে আমরা বলি চর্চা থাকলে, রাজনৈতিক দলগুলোতেও গণতন্ত্র চর্চিত হত। যেহেতু রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতান্ত্রিকতার ছিটেফোঁটাও নেই বা ছিল না, তাই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ও প্রকাশ ঘটেনি। বিষয়টি ভাইস-ভার্সা। একে-অপরের পরিপূরক। গণতন্ত্রের চর্চা পুঁজিপতিদের দর্শন। আবার বাম ঘরানার দলগুলো এক ধরনের রাজনৈতিক অটোক্রেসির অধীন। অনেকটাই হ্যাঁ ভোট না ভোটের মতো। হ্যাঁ জয় পেলে তিনিই সর্বেসর্বা হয়ে উঠেন। তারা রাষ্ট্রক্ষমতায়ও সাম্য সমাজ ও কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান। তাদের জন্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হারাম। পৃথিবী রাজনৈতির কোনো কমিউনিজম আক্রান্ত দেশে মতপ্রকাশ করলে তার নির্ঘাত মরণ। বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র তাই দক্ষিণপন্থিদের পৃথিবীর অনুসারীদের রাজনৈতিক বিষয়।
আজকে যারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাংবাদিকতার স্বাধীনতার কথা বলছেন, তারা কতটা সেই কথিত বিষয়ে বিশ্বাস করেন? এদের একটি বড় অংশ মনে করেন পত্রিকার মালিকের স্বাধীনতাই আসলে সাংবাদিকের স্বাধীনতা। কালাকানুনমুক্ত হওয়ার পর সংবাদপত্রগুলো বেশ উল্লাস করেছিল। তারা অচিরেই দেখতে পেল সেই স্বাধীনতার নাটাই ধরে আছেন মালিক ও তার নিজস্ব লোকেরা। তাই সাংবাদিকের স্বাধীনতা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। আমরা আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে পনেরো বছর, ‘উদ্দিন’দের দুই বছর, জিয়া-এরশাদের ১০ বছর এবং শেখ মুজিবের সাড়ে ৩ বছরের শাসন দেখেছি। ওই সময়গুলোতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা আমরা পাইনি। যতটুকু ছিল তাও আমরা হারিয়েছি। আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও দলগত চিন্তার খোলসে আমরা সাংবাদিকতাকে ঠাঁই দিয়েছি। যখন যে পত্রিকায় আমরা কাজ করেছি, তখন সেই পত্রিকার আদর্শ মেনেই করেছি। আর সেই আদর্শের নির্মাতা হচ্ছেন মূলত সাংবাদিক সম্পাদক ও মালিক সম্পাদক। তাদের শ্রেণি স্বার্থে, তাদের ব্যবসায়ী স্বার্থে যতটা উদার হওয়া যায় ততটাই তারা ছিপ থেকে সুতা ছাড়তেন বা এখনো ছাড়েন। এটাই হচ্ছে মাছ শিকারির স্বাধীনতা। তিনি বিনিয়োগকারী বলে যা করতে বলবেন, সাংবাদিক তাই করতে পারেন, তার বাইরে যেতে পারেন না। এই চর্চার ক্ষমতা বহন করেন সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, প্রধান প্রতিবেদক এবং তোশামোদকারী মূলত।
আমরা ওই টানেলের ভেতরে বাস করতে করতে আমাদের চিন্তা করার স্বাধীনতাটাই ভুলে গেছি। আমরা ভুলেছি যে সাংবাদিকতা একটি সৃষ্টিশীল কাজ। এর জন্য পড়াশোনা ও মানে জ্ঞানার্জন জরুরি। এবং সাহস। সাংবাদিকতায় ওই সাহস নামক ভোমরাটি কেবলই চিন্তার ওপর দিয়ে চক্কর মারে, একবারও ধরা দেয় না।
তিন : এই যে কথাগুলো বললাম, এই রচনা শেখ হাসিনার সময় প্রকাশ করা যেত না। ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার যথেষ্ট উদার ভূমিকা নিয়েছেন। তাই এখন বলতে গেলে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ বাধাগ্রস্ত হবে না। তবে যিনি লিখবেন, তার রয়েছে একটি দায় ও দায়িত্ব। তিনি স্বাধীন বলেই তার মাথায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতাই কেবলমাত্র তাকে সাহসী কথা লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। আমার এই লেখায় ক্ষিপ্ত হতে পারেন বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অন্য রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। এমনকি পতিত আওয়ামী ল্যাসপেন্সারগণ দাঁত কিড়মিড় করে আমার চৌদ্দগোষ্ঠীও উদ্ধার করতে পারেন। এটাই তাদের রাজনৈতিক স্বভাব। এই স্বভাব পরিত্যাগ করার সময় এসেছে। এটা যদি বুঝতে না পারেন, তাহলে আমি বলব, তারা পিছিয়ে আছেন।
চার : সংবাদপত্রে বিনিয়োগকারীরা ধনবান, এটা সবাই জানেন। অতীতে এমনটা প্রায় ছিলই না। অধিকাংশ পত্রিকার মালিক ছিলেন সাংবাদিক। তখন একটা সৌহার্দ্য সংবাদপত্রের অফিসের বাতাসে ভেসে বেড়াত। একটা সহমর্মিতা, একটা ভালোবাসা জনে জনে বিলি করত দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। কিন্তু এখন সংবাদপত্রগুলোর এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিকরা চাঁদ সওদাগরের মতো ধনপতি। তারা করপোরেট হাউসের অধিপতি। আর তাই মালিকরা পাঁচ তারকা হোটেলে বসে মিটিং করেন এবং সংবাদপত্রের যেন আর অনাকাঙ্ক্ষিত হামলার ঘটনা না ঘটে তার জন্য সুপারিশ করেন সরকারের কাছে। এবং যারা ওইসব অপকর্ম করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি করেছেন তারা।
কথায় আছে, এক হাতে তালি বাজে না। মানে যারা হামলা করেছে, তা যে প্রতিক্রিয়াজাত তা মানতে হবে। তারা কেন প্রতিক্রিয়াটা হামলা করে জানাচ্ছে? গণতান্ত্রিক বোধ তা অপরাধমূলক বা অন্যায়, অন্যায্য। কিন্তু পত্রিকা যদি এমন রিপোর্ট করে যা উস্কানিতে পরিণত হতে পারে না হয়, তাহলে কি আমরা হামলাকারীদের অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারব? শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার এক দিন কি দুই দিন আগে জাতির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তার কী অন্যায়? আমাকে কেন পদত্যাগ করতে হবে? আমার কী অপরাধ? আমি তো তাদের সঙ্গে বসতে চেয়েছি (বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কোটা সংস্কার নিয়ে)। ঠিক একই ঘটনা প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের ব্যাপারে খাটে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ওই দুটি পত্রিকা অনেক সার্ভিস দিয়েছে। তারপরও কেন কিছু মানুষ তাদের ওপর ক্ষিপ্ত? কেন ক্ষিপ্ত, সেই কারণ ওই দুটি পত্রিকার মালিক, সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্টদের খুঁজে বের করতে হবে। কোথায় কোথায় তাদের ঘাটতি আছে তা খুঁজে বের করে তার সমাধান করতে হবে। নিউজ পরিবেশনা আর নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নের বিষয়টি আলাদা। নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নে বোঝা যায় পত্রিকার মূল মটো কী? সভায় স্বাগত বক্তব্যে নোয়াব সভাপতি ও সমকাল পত্রিকার উদ্যোক্তা এ কে আজাদ ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর বিরুদ্ধে হুমকি ও চাপ প্রয়োগের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে যখন সংবাদমাধ্যমগুলোর চাপমুক্ত পরিবেশে কাজ করার কথা, তখন কোনো কোনো সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা ও হুমকি অব্যাহত রয়েছে। কর্মসূচির নামে দুটি পত্রিকা অফিস ঘেরাও, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, দেশের বিভিন্ন স্থানে অফিসে হামলা এবং পত্রিকা বিতরণে বাধা সৃষ্টির যে ঘটনা ঘটছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসবের মাধ্যমে যে ভয়ভীতির পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, তা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য চরম হুমকি।
এ কে আজাদ ঠিক কথাই বলেছেন। কিন্তু তার ঠিক কথাটা তো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীরা মানবেন না। তাদের রয়েছে একটি বিশেষ লক্ষ্য। যারা হামলা করেছে তাদের মৌলবাদী গোষ্ঠী বলা যেতে পারে। তারা প্রথম আলো অফিসের সামনে এসে মিটিং করেছে, নামাজ পড়েছে, গরু জবাই করে জিয়াফত দিয়েছে। এটা তো প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। ফ্যাসিবাদ উৎখাতে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, সেখানে বিষয়টি ভুলে থাকতে চায় তারাই, যারা পানি ঘোলা করে মাছ শিকার করতে চাইছে। তারা কারা এদের অবদান থাকতে পারে, কিন্তু প্রথম আলো, ডেইলি স্টার তো আর ফ্যাসিবাদী সরকার নয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার? তারা কি ফ্যাসিস্ট পতিত সরকারের অনুগত দাস? নাকি মৌলবাদীদেরই একটি ডিরেইলড অংশ, যারা ওই দুটি পত্রিকা থেকে তাদের কোনো সুবিধা পায়নি বলে চক্রান্ত করেছে।
এ দেশের মানুষ এখন অনেক সজাগ-সচেতন- এটা মনে রাখতে হবে উভয়পক্ষকে। মনের ভেতর যদি কুবুদ্ধি জন্মায়, তাহলে সেই আগাছা পরিষ্কার করতে হবে গণতান্ত্রিক চেতনা ও বিশ্বাস দিয়ে। আর আলোচনার টেবিল তো আছেই। প্রকাশ্যে আসেন, বলেন, প্রথম আলোর ভূমিকায় আপনার বা সমাজের ক্ষতি কোথায় হয়েছে। দেশের নতুন স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কী গেছে ওই পত্রিকা দুটির নীতি-আদর্শ? যদি তেমনটা হয়ে থাকে, তাহলে তাদের কাছে সেটা তুলে ধরলেই সমস্যার সমাধান হতে পারে। ভাঙচুর করে অন্যের অধিকার খর্ব বা হুমকি জারি রেখে নিজেদের গণতান্ত্রিক প্রমাণ করা যাবে না।
পাঁচ : আমি সাংবাদিকতার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। এই বিশ্বাস আমৃত্যু আমি বহন করব। আমি যেহেতু একজন কবি ও গদ্যশিল্পী, তাই লেখার স্বাধীনতা ছাড়া কোনো প্রকৃত সৃজনশীল মানুষ সাহসী ভূমিকা রাখতে পারে না। কবি ঈশ্বরের মতো স্বয়ম্ভু, তিনি কেবল নিজের সত্যকেই সৃষ্টি করেন। তার কোনো সহযোগী নেই, সহযোদ্ধা নেই। তিনি একা ও এককসত্তা। সেই সত্তার বিনষ্টি ঘটায় লোভ। বিত্তের লোভে অনেক সাহিত্যিকই দল দাসে পরিণত হয়, আমরা তাদেরই দেখছি মানস নয়নে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
"