খন্দকার আপন হোসাইন
দৃষ্টিপাত
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাম্প্রতিক বিদ্বেষ
বঙ্গদেশের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’। দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট নাসিরুদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ুন বাংলার রূপ প্রকৃতির প্রাচুর্যে মনোমুগ্ধ হয়েছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে বাংলার নাম দিয়েছিলেন জান্নাতাবাদ। বঙ্গ ভূখণ্ডটি সুদূর অতীত থেকে বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর তত্ত্বাবধানে থেকেছে। যে শাসক একবার এই ভূখণ্ডের দখল নিয়েছেন তিনিই আজীবন বাংলায় থাকতে চেয়েছেন। স্থানীয় জনগণও স্বেচ্ছায় সেই শাসকের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে নিয়েছে। শাসকগোষ্ঠীও তার অধীন জনগোষ্ঠীকে একান্ত আপন ভেবেই কাজ করে গিয়েছে। এভাবেই চলেছে দীর্ঘকাল। বিভিন্ন আমলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে জ্ঞানার্জনের আপ্রাণ চেষ্টা চলেছে। বিহার তৈরি হয়েছে। শিক্ষাদান হয়েছে। শিক্ষা বিনিময় হয়েছে। সুদূর প্রাচীন থেকে ব্রিটিশ শাসনামল পর্যন্ত প্রত্যেক শাসকই সচেতনতার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্র্রীতি রক্ষার চেষ্টা করেছে। এপার বাংলা ও ওপার বাংলায় সেই সম্প্রীতির গল্প এখনো লোকমুখে শোনা যায়। বৈষ্ণব সাহিত্যেও সেই ছবি লক্ষ্য করা যায়। বল্লাল সেন বাংলার হিন্দু বাঙালির মধ্যে কৌলিন্য প্রথার সংস্কার করেন। আবার বাংলায় ইসলামি শাসন প্রবর্তনের সময়ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঘাটতি ছিল না। হুসেন শাহের আমলকে বাংলায় ইসলামি শাসনের স্বর্ণযুগ বলা হয়। তখন বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ছিল চোখে পড়ার মতো। চৈতন্য এবং তার অনুগামীদেরকে ভক্তি প্রচারে হুসেন শাহ সহায়তা করেন। তার প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়েও হিন্দু কর্মকর্তা নিয়োগকৃত ছিল। বাংলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ধীরে ধীরে বিষবাষ্পের সৃষ্টি করে ব্রিটিশ শাসনের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান আলাদা হওয়ার আগ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ চরমে উঠেছিল। পরবর্তীতে পাক-ভারতজুড়ে যে পরিমাণ উদ্বাস্তু সমস্যা তৈরি হয়েছে তা পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) ও পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র জনবিস্ফোরণে রূপ নিয়েছিল। তবুও এপার বাংলার মানুষের সঙ্গে ওপার বাংলার মানুষ মিলেমিশে একাত্ম ছিল।
সম্প্রদায়ভিত্তিক বহুচর্চিত হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি কিংবা বিদ্বেষ হঠাৎ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার প্রধান ইস্যু হয়ে উঠেছে। ফেইসবুক স্ক্রল করলেই খোঁজে পাচ্ছি মুসলিম বিদ্বেষি ও হিন্দু বিদ্বেষি পাল্টাপাল্টি আগ্রাসী সব পোস্ট। চিরচেনা নম্র, ভদ্র, বিনয়ী হিন্দু বন্ধুটিও যেমন তীব্র ঘৃণাভরে মুসলিমবিরোধী পোস্ট দিচ্ছে আবার হিন্দুদেরও চরমভাবে ছোট করে উদ্ভট উল্টাপাল্টা পোস্ট দিচ্ছে তারই কোনো মুসলিম বন্ধু। ফেইসবুক, টুইটার ও ইন্সট্রাগ্রামের এই পরস্পরবিরোধী পোস্ট শুরু হয়েছে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ও ধর্মগুরু চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গত ২৫ নভেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। খারিজ হয়েছে জামিনের আবেদনও। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর দেশজুড়ে সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতনের একের পর এক অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। দেশের নানা প্রান্তে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ এসেছে। হিন্দুধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। ড. ইউনূস পরিচালিত অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি বলেও অভিযোগ হিন্দু সম্প্রদায়ের। অশান্তির আবহে বেশ কিছু ধর্মীয় সংগঠন মিলে তৈরি করে সনাতন জাগরণ মঞ্চ। মঞ্চের মুখপাত্র নির্বাচিত হয়ে উঠে চিন্ময় কৃষ্ণ। তারই ডাকা সমাবেশে যোগ দেন হাজার হাজার সংখ্যালঘু হিন্দু।
আপাতত চিন্ময় কৃষ্ণ বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রয়েছেন। আদালত নির্দেশনা অনুযায়ী বন্দি অবস্থায় চিন্ময়ের ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। চিন্ময় কৃষ্ণের গ্রেপ্তার ইস্যুতে বাংলাদেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের তরফ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারও। চিন্ময় কৃষ্ণের মুক্তি দাবিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ পথে নেমেছে। পক্ষান্তর ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে ইসকনকে। ইসকনকে নিষিদ্ধ করার দাবিও উঠেছে। ২৬ নভেম্বর চিন্ময় কৃষ্ণকে আদালত থেকে বের করার সময় আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী, আইনজীবী এবং চিন্ময় কৃষ্ণের অনুগামীদের মাঝে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় একজন আইনজীবী নিহত হন। পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়। ফলশ্রুতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠে হিন্দু-মুসলিম স্নায়ুযুদ্ধের অন্যতম ময়দান।
রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাংলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ হঠাৎ করে কেন আবার ঝুঁকির সম্মুখীন হলো? যুক্তির ধার না ধেরে শিক্ষিত সমাজ আবেগতাড়িত হলে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সমাজের কতটা গভীরে প্রবেশ করতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। ভূপেন হাজারিকার ‘মানুষ মানুষের জন্য/জীবন জীবনের জন্য/একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?’ কথাটি যেন আজ ফিকে হয়ে গেছে। এই ফিকে সত্যটা বুঝতে পারা মানুষরা বিপন্ন বোধ করছে। সেজন্যই কেউ নিরাপত্তাহীনতার কথা বলছে কেউ আবার বলছেন অসহিষ্ণুতার কথা। দুটোই অভিযোগ এবং অভিযোগ দুটিই সত্যি। দূরদ্রষ্টারা বুঝে গেছে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবন্ধন ঢিলে হয়ে গেলে সমূহ বিপদ। স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয়ে অসহিষ্ণু হয়ে উঠা একদল ফেইসবুকে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে এতেও সন্দেহ নেই। আবার কেউ কেউ এক মৌলবাদের জবাবে আরেক মৌলবাদকে আশ্রয় করে দিচ্ছেন। কারণ হতে পারে ভোট বৈতরণী পার। যেন আর কোনো রাস্তা নেই। এগুলোই সংকট বর্তমান অবস্থায়। কোথাও ইমামভাতা, কোথাও হিন্দু সাধুদের ভাতা। কোথাও রথ, তার বিপরীতে খোল-করতালের কীর্তন। কোনো চিন্তাভাবনার অবকাশ নেই। দেশের শিক্ষিতরাও সমানতালে অশিক্ষা কুশিক্ষা ছড়াচ্ছেন। মানুষের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক হিংসাকে জাগানোর কাজ করছে রাজনীতি। নিজেদের স্বার্থেই। জঘন্য কুরুচিকর ভাষায় চলে তার প্রচার প্রচারণা। কে কত বেশি জঘন্য ভাষা ব্যবহার করতে পারে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে। এগুলোই কি রাজনীতির পুঁজি?
সংখ্যাগুরুর মস্তিষ্ক থেকে সংখ্যালঘু শব্দটিকে মুছে ফেলা উচিত। ওপার বাংলায় অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের চালচলন সেখানকার সংখ্যাগুরু হিন্দুদের কাছে প্রীতিপ্রদ হয় না। এটা তোষণের ফল একইরকম তোষণ কী বাংলাদেশেও দৃশ্যমান। এই তোষণটাই মূলত সাম্প্রদায়িকতা। আমাদের বৈরিতা যেন নেহাতই একটি প্রতিক্রিয়া মাত্র। এই অবস্থা থেকে কি কোনো উত্তরণের উপায় আছে? আজ একটি উপায় সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তা হলো রাজনৈতিকভাবে সংখ্যালঘুদের এমন জায়গায় নিয়ে আসা যাতে তাদের কথা আর ভাবতেই না হয়। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু ভারতের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়। সংখ্যালঘু বৌদ্ধ মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়। সংখ্যালঘু বলে কাউকে ছোট করাটা নিতান্ত বোকামিই বটে। বিশ্বের যে সব দেশে সমাজের গণতন্ত্রীকরণ অসম্পূর্ণ রয়েছে সে দেশগুলোতে পারস্পরিক স্নায়ুযুদ্ধ আরো বেশি। আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব গণতন্ত্রীকরণের এই কাজটিকে অবহেলা করেছে। তাই এখানে সাম্প্রদায়িকতার মাটি উর্বর। এই মাটিকে কাজে লাগিয়েই এই ব্যবস্থার সেবকরা সাম্প্রদায়িকতাকে হাতিয়ার করে স্বার্থ সিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। এর বিপজ্জনক দিকগুলোর কথা মাথায় রেখে সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে সমাজের বুকে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মানসিকতা গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। ইতিহাসের গতিপথ ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের ভেতরেই অবস্থান করে। আর ইতিহাস পরিবর্তন সহজ কর্ম নয়। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ভয়ংকর স্রোত সমগ্র পৃথিবীকে সন্ত্রস্ত করে তুলছে। সাহসীচিত্তে এগিয়ে যেতে হলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাহিত্য-সংস্কৃতি-কৃষ্টি ও শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হবে।
লোকতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্রের দেশে মানুষ কি চায়? সাধারণ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা কি সত্যিই গণতন্ত্রে প্রতিফলিত হয়? বলা হয়ে থাকে সাম্প্রদায়িকতার চরম শত্রু যথার্থ গণতন্ত্র। অর্থাৎ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে সাম্প্রদায়িকতা দূর হবে। বর্তমানের এই পরিস্থিতির জন্য মূলত কারা দায়ী? একপক্ষ দোষ চাপাচ্ছে আওয়ামী লীগের ওপর। আরেক পক্ষ দোষ দিচ্ছে ড. ইউনূস সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যর্থতাকে। সব রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ দেশবাসীকে অশান্ত এই সময়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। ভোটের কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে রাজনীতি চলেছে এখনো। যার জন্য ফল ভুগতে হয় সব মানুষকে। ভোটসর্বস্ব রাজনীতির শিকার আমাদের এই সম্প্রীতির চারণক্ষেত্র বাংলাতেই এখন অশান্তি আছড়ে পড়ার চেষ্টা করছে? সম্প্রীতির শান্ত, স্নিগ্ধ বার্তা আজ ঘৃণা আর ভয়ের কালো থাবায় দিশাহারা।
বাংলাদেশে শুধু মুসলমানই বাস করে না। এখানে বাস করে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানের মতো বহু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এখানে রয়েছে নানা জাতি-উপজাতি। এত জটিল বহুমাত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে যদি বিভিন্ন জাতিসত্তার মুক্তি না ঘটানো হয় তবে বিপদ বাড়বেই। মানুষের ধর্ম আছে কিন্তু সন্ত্রাসবাদের কোনো ধর্ম নেই। সন্ত্রাসবাদের কোনো জাত নেই। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষও সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞায় পড়ে। পৃথিবীজুড়ে সাম্প্রদায়িকতার যে অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য সঠিক অনুশীলন প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপরায়ণ উভয় পক্ষের চরমপন্থি মনোভাব বর্জন করতে হবে। কাজী নজরুলের ভাষায় উচ্চস্বরে বলতে হবে ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলামান, মুসলিম তার নয়নমনি হিন্দু তাহার প্রাণ’। লেখক : গবেষক ও সংগঠক
"