বিশেষ সাক্ষাৎকার
‘দুর্নীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্যকে কুঠারাঘাত করছে’
সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ। নিয়োগ পেয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা, সেবা ও অন্যসব ক্ষেত্রে সংস্কার কাজে নেমেছেন। সেইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের একটি আধুনিক, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, বৈষম্যহীন, ছাত্রবান্ধব, দুর্নীতিমুক্ত ও আদর্শভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় উপহার দেওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। গত ২২ নভেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিদিনের সংবাদে বিশেষ সাক্ষাৎকারে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে উপাচার্য তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, প্রত্যাশা ও সংস্কারের কথা জানিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রতিদিনের সংবাদের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জিসান নজরুল
ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব এক অভ্যুত্থানের পর আপনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়কে কোন পর্যায়ে দেখতে চান?
আমি বিশ্বাস করি, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণেই আমি উপাচার্যের আসনে বসতে পেরেছি। তাই জুলাই বিপ্লবে যারা শহীদ হয়েছে, আহত হয়েছে এবং এখনো যারা সংস্কারের কাজ করে যাচ্ছে, আমার এ দায়িত্বগ্রহণকে তাদের জন্য নিবেদিত করছি। শহীদদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করার জন্যই আমি কাজ করছি এবং করব। আমি ইবিকে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পর্যায়ে একটি নমুনা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। পাশাপাশি শিক্ষা, গবেষণা ও সেবার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই যাতে আন্তর্জাতিক র্যাংকিং ইনস্টিটিউটগুলোর দৃষ্টি কেড়ে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে আসতে পারি।
বিগত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যসহ বিভিন্ন ব্যক্তির দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এসব দুর্নীতি তদন্তে আপনি কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
যারা দুর্নীতি করেছে তারা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্যকে কুঠারাঘাত করেছে। অবশ্যই তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে সাব্যস্ত করা হবে। কারণ যদি তারা শাস্তি না পায় ভবিষ্যতে তারা আরো প্রশ্রয় পাবে। বিশেষ করে শিক্ষক নিয়োগ ও উন্নয়ন প্রকল্পসহ বিভিন্ন আর্থিক ক্ষেত্রে যারা দুর্নীতি করেছেন তাদের বিষয়ে অতিদ্রুত তদন্ত করা হবে।
বিগত সময়ে উপাচার্যরা শুরুতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও পরবর্তীতে তারা নিজেরাই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এ বিষয়ে আপনার ভাবনা কী?
আমি যদি দুর্নীতি করি সাংবাদিকরা আমার বিরুদ্ধে লেখালেখি করুক। আমার প্রতিজ্ঞা হচ্ছে- আমি দুর্নীতি করব না, কাউকে করতেও দিব না। যদি আমি ভুলে বা ইচ্ছাকৃতভাবে একটি পয়সাও অনিয়মভাবে খরচ করি, নির্দ্বিধায় তোমরা আমার বিরুদ্ধে লেখ। আমি প্রশংসা নয় সমালোচনা পছন্দ করি। কারণ ভালো কাজ করলে সবাই এমনিতে প্রশংসা করবে।
অনেকেই মনে করেন যে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটিকে তার মূল লক্ষ্যে ফিরিয়ে আনতে আপনার ভূমিকা কী থাকবে?
এ প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামী ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় সাধন করে উন্নত শিক্ষায় অবদান রাখা। আমি নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করছি। সেজন্য আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে পরিবর্তন নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রতিটি বিভাগে সংশ্লিষ্ট ইসলামী শিক্ষা ও থিওরি সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেইসঙ্গে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিভাগ খোলারও পরিকল্পনা রয়েছে। এমনকি মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ওআইসি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রথম পর্যায়ে যেভাবে সহযোগিতা পেত সেটি পুনঃস্থাপিত করার চেষ্টা করছি।
প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের সনদ ও মার্কশিট তুলতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। ভোগান্তি নিরসনে শিগগিরই ডিজিটালাইজেশন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অটোমেশন সিস্টেম চালু করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে আপনি কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
এ ভোগান্তি দূর করতে এরই মধ্যে আমি আইসিটি সেলকে একটি ভালো কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। খুব শিগগিরই ডিজিটালাইজড সিস্টেম সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব। সেইসঙ্গে অটোমেশন সিস্টেমও চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতের মান বৃদ্ধিতে আপনার ভূমিকা কী থাকবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণার মান উত্তরোত্তর এগিয়ে নিতে চাই। আমাদের একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট আছে, তবে সেটি যথেষ্ট নয়। আমি এমন একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে চাই যেখানে আর্টস, সায়েন্স ও কর্মাসের আলাদাভাবে গবেষণার সুযোগ থাকবে। সেইসঙ্গে বিভাগ ও অনুষদভিত্তিক গবেষণাগার চালু করার জন্য শিক্ষকদের পরামর্শ দিয়েছি। এর জন্য শিক্ষকদের প্রশাসন থেকে অনুদান দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছি। আমাদের ল্যাবের অবস্থাও নড়বড়ে, উন্নতমানের ল্যাবের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণায় আগ্রহী হয় এমন ব্যবস্থার চেষ্টা করছি। সেইসঙ্গে একটি গবেষণা প্রকাশের জন্য পাবলিশিং হাউজ তৈরি করতে চাই। শিক্ষকরা যেন তাদের গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত ভাতা পায়, সেজন্য আগামী বাজেটে ভাতা নির্ধারণও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালের মান আন্তর্জাতিকমানের করা হবে। গবেষণার গুনগত মান বৃদ্ধি ও প্ল্যাজিয়ারিজমমুক্ত গবেষণার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে আপনি কী ভাবছেন?
আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ডায়ালগ সিস্টেমের মাধ্যমে শিগগিরই একটি সমাধানে আসব। তবে আমরা চাই লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি না থাকুক তবে আদর্শভিত্তিক রাজনীতি থাকবে। এমন রাজনীতি চাই যেখানে ছাত্ররা শিক্ষা সংস্কার ও প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করবে। হলগুলোতে কোনো ছাত্রসংগঠনের আধিপত্য থাকবে না। এজন্য মেধার ভিত্তিতে সিট বণ্টন করা হবে। ব্যক্তিগত স্বার্থ উপেক্ষা করে সামষ্টিক স্বার্থকে জোর দেওয়ার জন্য সব ছাত্র সংগঠনকে আমি অনুরোধ করেছি।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ তারা দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক পাচ্ছেন না। সেক্ষেত্রে আগামীতে কেমন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামীতে সম্পূর্ণ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। যদি আমি আমার ইচ্ছা প্রতিফলন করতে পারি তাহলে নিয়োগকৃত শিক্ষকরা হবেন ব্র্র্যান্ডেড ও অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন। এখানে কোনো দুর্নীতি করার সুযোগ থাকবে না। এসব নিয়োগে কোনো পলিটিক্যাল প্রভাব থাকবে না। যেটি আমরা জুলাই বিপ্লব থেকে শিক্ষা পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কয়েকটি বিভাগ চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছি। এক্ষেত্রে লেকচারার পর্যায়ের শিক্ষক নয় অধ্যাপক পর্যায়ের শিক্ষক দিয়ে বিভাগগুলোর কার্যক্রম শুরু করব।
শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি নিশ্চিত করার বিষয়ে আপনার ভূমিকা কী থাকবে?
আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছি। শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনে মনিটরিং সেল গঠন করা হবে। তবে এটা শিক্ষকের বিরুদ্ধে কাজ নয়। এটা আমার দায়িত্ব। ছুটির নিয়ম ভঙ্গ করে যারা দিনের পর দিন ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করেন ও মাঝে মাঝে এসে ক্লাস নেন। তাদের এ অনৈতিকতাকে নিয়ম হতে দেওয়া হবে না। নিয়মিত ছুটির বাইরে গিয়ে কাউকে অনুপস্থিত থাকতে দেওয়া হবে না। বিশ্বাস করি এ বিষয়ে আমি সবার সহযোগিতা পাব।
বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিকমানের পর্যায়ে নিয়ে যেতে আগামীতে কী কী করবেন?
আন্তর্জাতিকমানের করতে হলে অবশ্যই আন্তর্জাতিকমানের ব্যক্তি ও নেটওয়ার্কিং তৈরি করতে হবে। আমি বিশ্বের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নেটওয়ার্কিং তৈরি করতে চাই। বিশ্বের অন্য আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন বিভাগ খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রত্যেক বিভাগে ভালোমানের ইংরেজি কোর্স বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমেরিকান কর্নার করার প্রস্তাব পেয়েছি। বাজেট পেলে শীঘ্রই এটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করব। সেইসঙ্গে আইএলটিএস কেন্দ্র করারও পরিকল্পনা রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, পরিবহন সমস্যা ও পরিবেশগত সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা এখন বিদ্যমানও রয়েছে। এ সমস্যাগুলো নিরসনে আপনার অগ্রগতি কেমন?
ইতোমধ্যে খাবারের বিষয়ে খোঁজ নিতে বিভিন্ন হল পরিদর্শন করেছি। এ দিকটি ভালো করার বিষয়ে নিরন্তর প্রচেষ্টায় আছি। নতুন আবাসিক হল ও অ্যাকাডেমিক ভবনগুলো হয়ে গেলে আবাসন ও ক্লাসরুম সমস্যা অনেকটাই কেটে যাবে। পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের জন্য ভবনভিত্তিক ক্লিনিং কমিটি গঠন করা হবে।
"