এম এ মাসুদ

  ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

মুক্তমত

দারিদ্র্যবিমোচনে গ্রাম্য মহাজনদের লাগাম টানুন

সংস্কৃত মহাজন শব্দ আক্ষরিক অর্থে মহৎ মানুষ বুঝালেও প্রায়োগিক অর্থে সোনা, রুপা বন্ধক রেখে ধার দেওয়া ব্যক্তি কিংবা সুদে টাকা ধার দেওয়া কুসীদজীবীকে বুঝায়। এসব গ্রাম্য মহাজন অর্থনীতি না পড়লেও সুদের সংজ্ঞাটি কিন্তু বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন! ‘সুদ হলো নগদ অর্থ হাতছাড়া করার পুরস্কার।’ অন্যভাবে বলা যায়, ‘সুদ দিন, ধার নিন।’ আপনি যত আপনজনই হন, গ্রাম্য মহাজনরা আপনাকে ধারে টাকা দেবে না। দৈনিক, সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক লাভের প্রলোভন পেলে তবেই মেলে ধারে টাকা। টাকা দেওয়ার সময় বলবে, ‘অন্যের টাকা, মাস শেষে যেন ঘুরতে না হয়।’ সুদে টাকা ধার এবং তা আদায়ের কী অভিনব ফন্দি গ্রাম্য মহাজনদের!

উপনিবেশিক যুগে অধিকাংশ ভূস্বামী করতেন মহাজনী ব্যবসা। বর্গাচাষি কিংবা রায়তদের কৃষিঋণ দিতেন এবং সুদসহ তা আদায় করতেন তারা। ওই সময়ে সব ধরনের পাওনাদারকে মহাজন বলা হলেও অর্থনীতিতে মহাজন কর্তৃক কৃষককে সুদে টাকা ধার দেওয়ার নাম ‘গ্রাম্য মহাজন।’ এই গ্রাম্য মহাজনরা কৃষিঋণের অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এখন শুধু কৃষকই নন, গ্রাম্য মহাজনদের থেকে সুদে টাকা ধার নিচ্ছেন মুটে, মজুর, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতীসহ চাকরিজীবীও। স্বল্প মূলধনে বেশি লাভ। তাই সাধারণ মানুুষের মাঝেও অনেকেই বেছে নিচ্ছেন সুদে কারবারকে। পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে নেই নারীরাও। তারাও সম্পৃক্ত হচ্ছেন লাভজনক এমন পেশায়। সমবায় দপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে গ্রামগঞ্জের হাট-বাজার এবং রাস্তার মোড়ে মোড়ে সমবায় সমিতির নামে গড়ে উঠেছে সুদের কারবার। অতীতে মহাজনরা টাকা ধার দিতেন সুদের বিনিময়ে, আর জামানত হিসেবে রেখে দিতেন স্বর্ণ, রুপা, পিতল বা কাঁসার বাসন। কিন্তু বর্তমানে গ্রাম্য মহাজনরা চাকরিজীবী, সাধারণ কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবীদের থেকে জামানত হিসেবে রেখে দিচ্ছেন স্বাক্ষরিত ফাঁকা চেক ও স্ট্যাম্প।

অভাবের মাত্রাভেদে তারতম্য হয় সুদের হারেও। চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে মাসিক সুদের হার শতকরা ৬-১০ টাকা হলেও শ্রমজীবী মানুষ এবং হাটবাজারের খুদে ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে সেই হার হয়ে থাকে ১০ থেকে ২০ টাকা। আর মাস শেষ না হতেই টাকা গ্রহীতাদের সুদের জন্য তাড়া দিতে থাকেন মহাজনরা। চাকরিজীবীদের বেতন ব্যাংকে জমা হলেই চেকের বান্ডিলসহ দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ভিড় জমে গ্রাম্য মহাজনদের।

বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, শিলাবৃষ্টি, পঙ্গপালের আক্রমণে প্রভাব পড়ে কৃষিতে। রয়েছে ছদ্মবেশী বেকারত্বও। ফলে কোনো কারণে সুদের টাকা পরিশোধে বিলম্ব হলে তা আসলের সঙ্গে যোগ করতে থাকেন সুদে কারবারিরা। সুদ ধরেন চক্রবৃদ্ধি হারে। আর সুদ চালাতে গিয়ে বিভিন্ন মহাজনের নিকট আরো চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ঋণের জালে আটকা পড়েন কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ ও খুদে ব্যবসায়ীরা। একসময় মহাজন ও তার লাঠিয়ালদের ভয়ে ছেড়ে দেন হাটবাজার যাওয়া। বাড়ি দখল, বেঁধে রাখা এবং অপমানিত হওয়ার ভয়ে অবশেষে জমি কিংবা বাড়ি ভিটা বিক্রি বা বন্ধক রেখে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য হন তারা। শেষে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হারিয়ে পরিবার-পরিজনসহ গ্রাম ছাড়েন এসব মানুষ। ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত বাড়িতে ফেরার আর সাহস হয় না দুর্ভাগা মানুষগুলোর। চাকরিজীবীরা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে গ্রাম্য মহাজনরা স্বাক্ষর করে নেওয়া ফাঁকা চেকে ইচ্ছেমতো টাকার অঙ্ক বসিয়ে আদালতে ঠুকে দিচ্ছেন চেক ডিজঅনার মামলা। অনেকেই বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন আত্মহত্যার মতো পথও।

ড. আবদুল হামিদের মতে যেখানে, গ্রামীণ উন্নয়ন একটি ধীমান প্রক্রিয়া, যা পল্লীর সর্বস্তরের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চিয়তা প্রদান করে এবং সার্বিক উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। সেখানে সুদে কারবারিদের কবলে পড়ে প্রান্তিক কৃষক হয়ে পড়ছেন ভূমিহীন, ভিটে বাড়ি যাদের ছিল তারা হচ্ছেন গৃহহীন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসা হারিয়ে হচ্ছেন বেকার এবং শ্রমজীবীরা হচ্ছেন গ্রামছাড়া। যারা একসময় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতেন, সেই তারাই কী না এখন দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত! মানুষ হয়ে পড়ছেন দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্র।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের সর্বশেষ তথ্য মতে, বাংলাদেশের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। এর মধ্যে অতি দরিদ্রসীমার নিচে বাস করছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ। সর্বশেষ জনশুমারি অনুসারে, দেশে বর্তমানে জনসংখ্যা আছে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার। সে হিসেবে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ১৭ লাখ ৫৭ হাজার।

দারিদ্র্যের নানাবিধ কারণের মধ্যে গ্রাম্য মহাজনদের শোষণ অন্যতম। সুদে কারবারি এসব মহাজন শ্রমজীবী মানুষের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের সুফল ভোগ করে হচ্ছেন পুঁজিপতি, কিনছেন জমি, দামি গাড়ি, করছেন বাড়ি। ফলস্বরূপ সমাজে বাড়ছে আয় বৈষম্য ও দারিদ্র্যের হার। তাই আয় বৈষম্য দূর ও দারিদ্র্য বিমোচন করতে হলে উপজেলা পর্যায়ে সমবায় দপ্তর কর্তৃক দেওয়া রেজিস্ট্রেশনভুক্ত সমবায় সমিতিগুলোর কার্যক্রমে নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি গ্রাম্য মহাজনদের কর্মকাণ্ড এবং তাদের থেকে নেওয়া ঋণের কুফল সম্পর্কে মিডিয়ায় বেশি বেশি প্রচারণা চালাতে হবে। তবেই উৎপাদন, আয়, ভোগ, বণ্টন, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ দরিদ্রদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হবে দেশ, কমবে অর্থনৈতিক বৈষম্য।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close