মজিবর রহমান

  ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

বেকারত্ব পরিস্থিতির উন্নতির জন্য করণীয়

অন্তর্বর্তী সরকার নানারকম সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। স্বীকার করতেই হবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রয়োজন আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। প্রকৃতপক্ষে সব সমস্যার মূল হলো নির্বাচন ব্যবস্থার ত্রুটি। অতীতের হাতেগোনা কয়েকটি নির্বাচন ছাড়া কোনোটিতেই জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটেনি। অর্থ ও পেশিশক্তির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিল নির্বাচন। মানুষ ভোট দিতে পারেনি। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ছিল না। যে কারণে অশান্তি ও অস্থিরতা পিছু ছাড়েনি জাতির। আওয়ামী লীগের সরকার হুড়মুড় করে ধসে পড়ার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ভোটাধিকার হরণকে চিহ্নিত করা যায়। ভোটের মূল্য না থাকায় জবাবদিহিতারও বালাই থাকেনি, তাতে দুর্নীতি দিন দিন প্রবলাকার হয়েছে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব বিরাজ করেছে দেশে। সভ্য জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় জীবনে শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিতের প্রয়োজনে এমন পরিস্থিতির অবসান দরকার। বস্তুত নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারই আসল সংস্কার। এই সংস্কার আটঘাট বেঁধে করা না গেলে অন্য সংস্কার সুফল দেবে না। তবে সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য শুধু বিধিবিধান ও আইন প্রণয়ন নয়, রাজনীতিকদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। যারাই ক্ষমতায় যান সহজে আর নামতে চান না। এরকম মানসিকতার অবলোপন না ঘটলে কোনো সংস্কারই কাজে দেবে না।

অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কারকাজে হাত দিয়েছে সেসবের কোনোটিকেই অপ্রয়োজনীয় বলা যাবে না। ভবিষ্যতের জন্য নানামুখী সংস্কার নিঃসন্দেহে দরকারি। পাশাপাশি বর্তমানকে গুরুত্ব দেওয়াও অত্যাবশ্যক। মানুষের প্রাত্যহিক জীবন সত্যিকার অর্থেই বিপর্যস্ত। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা তো আছেই, ক্রমেই তীব্র হয়ে ওঠা বেকারত্ব এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি পরিসংখান অনুযায়ী দেশে প্রতি বছর ২০-২২ লাখ তরুণ নতুন করে শ্রমবাজারে যুক্ত হন। এর ভেতর ১২-১৩ লাখের দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয়, ৮-৯ লাখ পাড়ি জমান বিদেশে। পরিসংখ্যানটি পুরোনো, পটপরিবর্তনের পর কী অবস্থা দাঁড়িয়েছে তার কোনো হিসাব বিবিএস এখনো বের করেনি। বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়, অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের, অনেক ক্ষেত্রে এই কর্মসংস্থান নামকাওয়াস্তের, যার দ্বারা তিনবেলা আহার জোগানোই কঠিন, চাওয়া-পাওয়ার অন্য হিসাবতো কষ্টকল্পনা। অর্থনীতির পরিভাষায় দেশে ছদ্মবেশী বেকারত্ব প্রকট। সাদা চোখে তাকালে বোঝা যায় বেকারত্ব কেমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে দিন দিন! এর প্রভাব গিয়ে পড়েছে বিগত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে, যাতে নির্মম পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের।

বেকারত্ব সমস্যা তরুণ সমাজের ভেতর প্রবল। শিক্ষিত তরুণদের অবস্থা নাজুক। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বের হার মোট বেকারের ৩১ শতাংশ। এতদিনে এই হার নিশ্চিত আরো বেড়েছে। বলাবাহুল্য উচ্চশিক্ষা এদেশে এখনো কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেয় না। অনেকটাই আত্মতুষ্টির ব্যাপার এটি। অন্যদিকে অভিযোগ আছে যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাই কর্মসংস্থানমুখী না। যার দরুন উচ্চ বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান, বিশেষত গার্মেন্টস শিল্পে ভারত-শ্রীলঙ্কা-ভিয়েতনাম থেকে উচ্চ দক্ষতার কর্মী আনতে হয়। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বায়িং হাউস তাদের ছাড়া চলে না। আবার আমাদের প্রদত্ত শিক্ষা যে মানবিক মূল্যবোধ শ্রেয়তর অথবা প্রকৃত জ্ঞানের প্রসার ঘটাতে পারছে তা-ও না। এ অবস্থায় কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন যে এই শিক্ষা তাহলে কেন কাজে লাগছে, তার সদুত্তর দেওয়া কঠিন। জাতীয় উন্নতি ও জাতীয় মর্যাদার জন্য পরিস্থিতির হেরফের অত্যন্ত জরুরি।

দেশে সরকারি চাকরির সুযোগ সীমিত। সেই সুযোগের অনেকটাই অব্যবহৃত। ওরগানোগ্রামে পদের কথা উল্লেখ আছে, বাস্তবে নেই। অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে অনেক পদ শূন্য রয়েছে। সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) অতিরিক্ত কর্মভারে ভারাক্রান্ত, বছরের পর বছর লেগে যায় একেকটি রিক্রুটমেন্টে। সরকারকে এ ব্যাপারে দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানাই। পিএসসির ওপর এই চাপ কমানোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। নতুন কর্মকৌশল অতি জরুরি। নিয়োগ প্রদানের জন্য অতিরিক্ত নতুন কর্তৃপক্ষের কথা ভাবা যেতে পারে, যাতে নিয়োগ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। বাস্তবতা হলো অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে কর্মস্পৃহাই নষ্ট হয়ে যায় অনেক তরুণের।

চাকরির গরিষ্ঠ অংশের জোগানদাতা বেসরকারি খাত। খাতটি মোটেও ভালো নেই। কয়েকবছর ধরে বিনিয়োগ কমছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি, বন্দর-অবকাঠামোর অনগ্রসরতা, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট, ডলারের অপর্যাপ্ততা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি নানা কারণে বিনিয়োগ থমকে গিয়েছিল। বিগত সরকার যতই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কথা প্রচার করুক, প্রধান বিরোধীদলের অংশগ্রহণবিহীন নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে পারেনি। বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ যে কতটা কঠিন তা বোঝাতে গিয়ে সিপিডির সাম্প্রতিক আয়োজিত এক সংলাপে একজন ব্যবসায়ী একটি উদাহরণ টেনেছেন। তার ভাষ্যমতে, এদেশে ব্যবসা শুরুর জন্য ১৭০ ধরনের নথিপত্র লাগে, কম্বোডিয়ায় লাগে ২৩, ইন্দোনেশিয়ায় ২০, ভিয়েতনামে ২১ ধরনের। (সূত্র প্রথম আলো, ১৮.১১.২৪)। ব্যবসা সহজীকরণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে বলাবলি হচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আক্ষেপ করে একজন ব্যবসায়ী বলছিলেন, এত সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে অথচ ব্যবসা পরিস্থিতির সংস্কারের কথা কেউ বলছেন না।

সাম্প্রতিক পরিস্থিতি আরো হতাশাজনক। পতিত সরকারের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের অনেকের শিল্পকারখানা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বন্ধ বা তীব্র সংকটে রয়েছে। এ নিয়ে কোনো জরিপ পরিচালিত না হলেও ধারণা করা যায় অনেক মানুষ নতুন করে বেকার হয়েছেন, অথবা বেকার হওয়ার আশঙ্কায় আছেন। অনেক জায়গায় শ্রমিক অসন্তোষের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এদের অনেকের মোটাদাগের ব্যাংক ঋণ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে কার্যক্রম মসৃণ রাখার কথা বলছে। স্মরণ করি, প্রশাসক নিয়োগের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বৃহৎ কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে সেগুলোতে প্রশাসক বসানো হয়েছিল। ফল ভালো হয়নি। অতীত অভিজ্ঞতার অভাব ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে উদ্যোগ বিফলে গিয়েছিল। বিগত দিনের এই অভিজ্ঞতা সামনে রেখে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সাভারের জিরানী বাজার বা বিকেএসপি সংলগ্ন এলাকায় বিরাজমান লাগাতার শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে স্বনামধন্য কোনো কোনো গার্মেন্টস শিল্পেও স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। উৎপাদন ও কর্মসংস্থান নির্বিঘ্ন করার স্বার্থে এসব দমন করা দরকার।

অন্তর্বর্তী সরকার রাতারাতি সব করে ফেলবে এমন প্রত্যাশা কেউ করে না। নানা কাজের ভিড়ে কর্মসংস্থানের বিষয়টি যাতে অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকে এমনটি চাই। বেকারত্বের জ্বালা প্রশমন করতে না পারলে অশান্তি দূর হবে না, এমনকি আইনশৃঙ্খলারও ব্যাঘাত ঘটতে পারে। বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে প্রতিকারের উদ্যোগ প্রয়োজনীয়। আগেই উল্লেখ করেছি, কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এর বড় জোগানদার। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক কিছুই স্থবির হয়ে আছে। দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে বড় ধরনের প্রকল্প নিয়ে ভাবনায় সরকার হয়তো সময় নেবে। ছোট ছোট কাজে খুব সহজেই গতি আনা যায়। উদাহরণ হিসেবে শহর ও গ্রামের রাস্তাঘাটের কথা ধরা যায়। এসবের সংস্কার দরকার। সেই কাজটি পূর্ণমাত্রায় শুরু করলে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান বাড়বে, ছোটখাটো ঠিকাদার ও তদসংশ্লিষ্ট ব্যবসার মন্দাভাব দূর হবে, সামগ্রিক অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়বে।

বেকারত্ব হ্রাস করার কিছুটা সহজ একটা উপায় আছে। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবে বিপুলসংখ্যক তরুণ বিদেশে গিয়ে কাজ করতে চান। সেই চাহিদাও আছে। প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তাদের বেশিরভাগের ইচ্ছা পূরণ হয় না। ম্যানপাওয়ার এজেন্সিগুলো মাত্রাতিরিক্ত টাকা নেয়, সিন্ডিকেট করে, মধ্যস্বত্বভোগী দালালরা ভাগ বসায়, ঠকবাজি করে- ইত্যাকার নানা কারণে উল্টোপথে বসতে হয় আগ্রহীদের। সরকার যদি পুরো প্রক্রিয়াটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়, বিনাসুদে টাকা-পয়সার জোগান দেয়, তাদের প্রশিক্ষিত করে বিদেশে পাঠায় তাহলে কর্মসংস্থানের এক বিরাট ক্ষেত্র তৈরি হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এ ব্যাপারে দৃষ্টান্ত তৈরি করে জাতিকে পথ দেখাতে পারে।

লেখক : কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close