মোনায়েম সরকার

  ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

মতামত

নৈরাজ্য মোকাবিলায় কঠোরতার বিকল্প নেই

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগজনক। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার একের পর এক সংকটের মুখে পড়ছে, যার ফলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন, বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে অবরোধ এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতির ঘটনা সামগ্রিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। এমন একসময়ে দাঁড়িয়ে যখন দেশকে রাজনৈতিক ঐক্য, দক্ষ নেতৃত্ব এবং কার্যকর প্রশাসনের প্রয়োজন, তখন এর অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।

সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিক্ষোভ পরিস্থিতিকে আরো উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এসব ঘটনার নেপথ্যে সরকারপ্রধানের নমনীয়তা এবং প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করা হচ্ছে। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, সরকারের পক্ষপাতমূলক প্রশাসনিক কাঠামো এবং নীতিগত দুর্বলতার কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলটির নেতারা একমত হন যে, সরকারের ব্যর্থতা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পরামর্শ না করার একটি বড় ফল।

সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর অন্যতম হলো-তারা নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে যথেষ্ট শক্ত অবস্থান নিতে পারেননি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন দাবিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিক্ষোভ মোকাবিলায় সরকারের প্রাথমিক দুর্বলতা পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, চাকরি স্থায়ীকরণ, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফল বাতিল এবং সম্প্রতি ইসকন নেতা চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির নজিরগুলো সংকট-ব্যবস্থাপনায় সরকারের ঘাটতিকে স্পষ্ট করেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ও উপদেষ্টারা বিভিন্ন সময়ে কঠোর অবস্থানের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবিক অর্থে তা কার্যকর হতে দেখা যায়নি। বরং সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোতে আগের সরকারের সমর্থকদের প্রভাব এবং পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবলের অভাব সংকটকে আরো তীব্র করেছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা পরিস্থিতি উত্তরণে সহায়ক ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে।

এই অস্থিরতার মধ্যে বিএনপির ভূমিকা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দলটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেও সরকারের ব্যর্থতার বিষয়ে বারবার সতর্ক করে আসছে। তাদের মতে, সরকারকে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে দেশের পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বিএনপি তাদের কর্মসূচির মাধ্যমে চক্রান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কথা বলছে এবং একইসঙ্গে সরকারকে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পু-রিক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় দেশের বিভিন্নস্থানে বিশৃঙ্খলা প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘এক্ষেত্রে আমার মনে হয় বাইরেরও (বিদেশি) কিছু হয়তো ইন্ধন আছে এবং দেশেও দুয়েকটা পার্টি আছে, তাদের থেকে হয়তো কিছুটা ইন্ধন আছে। আবার ধরেন, যাদের আমরা ব্যান্ড করে দিয়েছি, তাদের থেকেও কিছুটা ইন্ধন আছে।’

দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘৫-৬ আগস্ট থেকে অনেক উন্নতি হয়েছে। আমার কাছে তো এমন কিছু নেই যে বলব উন্নতি হয়ে যাক। আস্তে আস্তে তো কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আরো উন্নতি হওয়ার অবকাশ আছে এবং হবে। সবার সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন।’

৫ আগস্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লুট হওয়া সব অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অস্ত্র উদ্ধার অভিযান আমরা বন্ধ করিনি। অস্ত্র বাইরে থাকলে তো কিছুটা থ্রেট থাকবে।’

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যারা ভুয়া মামলা করছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘অনেক ভুয়া মামলা হয়েছে। এই ভুয়া মামলায় নিরাপদ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয়, এর ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। যারা ভুয়া মামলা করছে, আমরা তাদেরও আইনের আওতায় আনব।’

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি নিয়ে রাস্তা অবরোধ না করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসেও তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে, কিংবা আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ সমাধান।’

তবে সবসময় যে সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না- এটাও তো মনে রাখতে হবে।

আরেকটি বিষয়ে কিছু বলা জরুরি মনে করছি। গণমাধ্যম নিয়েও একধরনের বিশৃঙ্খলা শুরুর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এরই প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমে হামলাসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে মব জাস্টিস কঠোরহস্তে দমন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। একইসঙ্গে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপন্থী কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা।

সম্পাদক পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়, সম্পাদক পরিষদ উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে, দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতার ওপর নানাভাবে আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক প্রথম আলো, ডেইলি স্টার কার্যালয়ের সামনে অবস্থান, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর প্রধান কার্যালয়ের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করেছে কিছু ব্যক্তি। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। এখনো প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা হুমকিতে রয়েছে।

সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ বিষয়ে নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) উদ্বেগ জানিয়ে নিন্দা প্রকাশ করেছে। এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এ ধরনের ঘটনার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থার বার্তা দিয়েছেন, যা ইতিবাচক হিসেবে দেখছে সম্পাদক পরিষদ।

সম্পাদক পরিষদ মনে করে, কোনো পত্রিকার কোনো সংবাদ বা সম্পাদকীয় নীতিমালা নিয়ে কারো কোনো ভিন্নমত থাকলে তিনি যেকোনো মাধ্যমে নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান ও বক্তব্য তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু এভাবে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিকতার চর্চা ও পরিবেশকে ব্যাহত করছে। সম্পাদক পরিষদ এ ধরনের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজচিন্তকদের মতামতও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, সমাজের গভীরে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী আদর্শ কেবল সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে দূর করা সম্ভব নয়। সমাজে গণতন্ত্রের অভাব এবং কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা এসব সমস্যার মূল কারণ। একইসঙ্গে তিনি ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের মতে, সরকারের অতি ধীরগতির কারণেই এসব পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। যদিও সরকার ধরপাকড়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে, তবে তা দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ নয়।

এ সংকট উত্তরণের জন্য সরকারের প্রয়োজন কঠোর ও স্পষ্ট নীতি গ্রহণ। অব্যাহত নৈরাজ্য দমন করতে হলে সরকারের পক্ষপাতহীন প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে তাদের মনোবল চাঙ্গা করতে হবে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা এবং সংলাপের পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দেশের সংকট নিরসনে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস নিশ্চিত করা। ক্ষমতার রাজনীতির পরিবর্তে জনগণের দাবি-দাওয়া এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোতে তাদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

বর্তমান পরিস্থিতি রাজনৈতিক নেতাদের জন্য এক পরীক্ষার মুহূর্ত। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে দেশের অস্থিরতা আরো দীর্ঘায়িত হবে, যা কেবল জনগণের জন্যই নয়, বরং দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হবে। সময় এসেছে, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করার এবং ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখানোর।

লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close