এম আর খায়রুল উমাম
মুক্তমত
গঙ্গা ব্যারাজ ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে ভাবুন
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় জালের মতো সারা দেশে নদী ছড়িয়ে আছে। একেকটি নদী দিকে দিকে জালের মতো তার শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটিয়েছে। এখানে যেহেতু শুধু একটা নদী সংস্কার করে অন্যগুলো রক্ষার সুযোগ নেই, তাই সরকারি নদী সংস্কার কার্যক্রম ব্যর্থতার চাদরে ঢাকা পড়েছে বারবার। সংস্কার-সংশ্লিষ্টরা নদীকে সোনার ডিমপাড়া হাঁসে রূপান্তর করেছে। এলাকাবাসী আন্দোলন-সংগ্রাম করেই চলেছে। এ পর্যন্ত সব ‘জনদরদি সরকার’ প্রকল্প ফেঁদে ‘সংস্কার’ করেই চলেছে। প্রকৃত সংস্কার করে নদীকে বহতারূপে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেই।
আমরা দেখছি স্বার্থান্বেষী নানা গোষ্ঠী রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। দেশের পেশাজীবীরাও পেশাদারত্বে নিবেদিত না হয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলের অংশীজন হয়ে পড়েছে। ফলে প্রকৃত জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের গতি যতটা ধীর হয়েছে, তার চেয়ে শতগুণ দ্রুতগতিসম্পন্ন হয়েছে রাজনৈতিক প্রকল্প। নদীবিষয়ক প্রকল্পগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়।
বিগত সরকারের সময়ে দেখা গেল, চীনা অর্থায়নের তিস্তা মহাপ্রকল্পের বাস্তবায়ন শিকেয় তুলে রেখে দেওয়া হলো। মসনদের মোহে ভারতের প্রতিবাদের মুখে চীনা প্রস্তাবকে পাশ কাটিয়ে ভারতকেই তিস্তা মহাপ্রকল্পের রূপরেখা সমীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হলো। অথচ চীনের প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপ্রকল্পে শুধু বিশাল জলাধারই পাওয়া যেত না; পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, বনায়ন ও সেচ সুবিধা বৃদ্ধি পেত। সবচেয়ে বড় কথা, উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকা বন্যা ও খরার হাত থেকে রক্ষা পেত।
সাধারণ মানুষের বুঝে নিতে কষ্ট হয় না- চীনা অর্থায়নে তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়ন যারা অনুমোদন করতে পারে না, তারা কীভাবে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবে। ১৯৬৩ সালে আমেরিকার এক বিশেষজ্ঞ দল ফারাক্কা ব্যারাজের বিরূপ প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা পেতে গঙ্গা ব্যারাজের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে। সে সময় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এ অঞ্চলের জন্য জনগণের কল্যাণে এত টাকা ব্যয় করবে- তা বিশ্বাস করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই, স্বাধীন দেশের ক্ষমতাবানরাও এই ব্যারাজ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবার সময় ৫৩ বছরেও পেল না।
এটা ঠিক, গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে কথা কম হয়নি। কিন্তু বহু কৌশল করে, সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করে, স্থান নির্বাচন করে, প্রকল্প বাস্তবায়নে মানুষের মনে আশা জাগিয়ে শেষ পর্যন্ত ‘জনগণের অমঙ্গল শঙ্কায়’ ব্যারাজটির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। কারণ কী? সেই তিস্তা মহাপরিকল্পনার মতোই। গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প পরিকল্পনা ভারতের কাছে পাঠিয়ে অনুমতি প্রার্থনা করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। অথচ পাগলও বিশ্বাস করবে না, ভারত সরকার ব্যারাজ নির্মাণকে সমর্থন করতে পারে!
দেশের নীতিনির্ধারকরা যদি একটু পেছন ফিরে তাকাতেন, তাহলে দেখতে পেতেন ভারত সরকার তাদের দেশের কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অনুমতি দূরে থাক; তথ্য জানানোর প্রয়োজনও বোধ করেনি। একমাত্র টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের সময়েই দেশে আন্দোলনের মুখে পাঁচজন সংসদ সদস্যের একটা দল ভারতীয় আতিথ্য গ্রহণ করে এলাকা পরিদর্শন করে। যদিও সে সময়ের বিরূপ আবহাওয়ায় মেঘলা আকাশে হেলিকপ্টারে চড়ে প্রতিনিধি দল কী দেখতে পেয়েছিল এবং কী প্রতিবেদন দিয়েছিল, তা সাধারণ মানুষ জানে না।
আজ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর তিস্তা মহাপরিকল্পনা কিংবা গঙ্গা ব্যারাজের মতো প্রকল্পগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ তৈরি হয়েছে। কারণ পূর্ববর্তী ‘দেশপ্রেমিক’ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা দায়িত্বের আড়ালে আসলে ভারতের পছন্দমতোই নদীবিষয়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন বা বাতিল করেছেন। এমন কোনো অন্তর্নিহিত কারণেই ২০১৭ সালে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প বন্ধ করা হয়েছে এবং তিস্তা ব্যারাজ নিয়ে একের পর এক টালবাহানা করা হয়েছে।
লক্ষণীয়, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বা গঙ্গা ব্যারাজ; দুটি প্রকল্পেই চীনা অর্থায়নের প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার পাশ কাটিয়ে গেছে। ব্যারাজ দুটি বাস্তবায়ন করতে পারলেই যে বহুবিধ সমস্যার সমাধান সম্ভব ছিল, তা বলাইবাহুল্য। সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু যে বিশাল জলাধার পাওয়া যেত, তাতে এসব অঞ্চলের বড় অংশের ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব ছিল। পরিবেশ, কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ, নগরায়ণ সুবিধা বৃদ্ধি পেত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সুফল পাওয়া যেত তা হলো, সংযুক্ত সব নদনদীতে সারা বছর পানি পাওয়া নিশ্চিত হতো।
দেশের নদী গবেষকরা বলে থাকেন, যদি গঙ্গা ব্যারাজ বাস্তবায়ন করে গড়াই ও মাথাভাঙ্গা নদীতে পানি প্রবেশের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৬টি নদনদী সচল হয়ে যাবে। বাংলাদেশ অংশে পদ্মা নদীর গভীরতা ৩৯ ফুট বাড়াতে পারলে যে বিপুল জলরাশির মালিক আমরা হতাম, তাতে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় থাকার জন্য বিদেশি শক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের বৃহত্তম কল্যাণের কথা ভেবে অবিলম্বে চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে গঙ্গা ব্যারাজ বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়া কালের দাবি। অনেক দেরি হয়েছে, সন্দেহ নেই। তারপরও শুরু করা প্রয়োজন। অনুরূপ তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনা প্রস্তাব বিচার-বিবেচনা জরুরি। যদিও দুটি ব্যারাজের স্থান নির্বাচন যথাযথ হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন না। তারপরও প্রকল্প বাস্তবায়নে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ কামনা করি। জনকল্যাণের সরকার হলে বিষয়টি ভেবে দেখবে বলে আশা করি।
লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স
বাংলাদেশ (আইডিইবি)
"