ড. আলা উদ্দিন
মতামত
‘ট্যাগিং’ রাজনীতির অবসান প্রয়োজন
দল বা নিজ মতের (প্রধানত দ্বিতীয়টি) বিরুদ্ধে গেলেই অন্যকে একটা নেতিবাচক তকমা দিয়ে দোষারোপ করা সা¤প্রতিক সময়ে বিশেষত রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিশেষ প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত সরকার বিনা ভোটে বা কারসাজির ভোটে ২০১৪ সালে দ্বিতীয় দফায়, ২০১৮ সালে তৃতীয় দফায় এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে চতুর্থ দফায় ক্ষমতাসীন হয়। কথায় কথায় কোনো কাজের সমালোচনাকারীকে; এমনকি নিজ দলের পরীক্ষিত নেতাদের কটাক্ষ করা, জামায়াতি বা রাজাকার তকমা দিয়ে ছোট করা তখন প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতা দলীয় মতাদর্শের মতো ছড়িয়ে যায় সবখানে। এজন্য আওয়ামী ঘরানার নিবেদিত মানুষকেও সরকার বিষয়ে তাদের বস্তুনিষ্ঠ অবস্থানের জন্য সদা শঙ্কায় থাকতে হতো- কখন আবার জামায়াতি বানানো হয়! সেই সরকার ইতোমধ্যে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিপরীত মতের লোকদের তকমা দেওয়ার প্রবণতা এখনো লক্ষণীয়। আওয়ামী লীগের বহুল ব্যবহৃত এই অপকৌশলটি এখন অন্যদের মাঝেও সংক্রমিত হয়েছে। আওয়ামী ঘরানার মানুষকে গড়ে নির্বিচারে বিগত সরকারের দোসর বলা হচ্ছে। যারা বিশেষ করে জুলাই তৃতীয় সপ্তাহ বা আগস্টের প্রথম সপ্তাহ এবং এমনকি ৫ তারিখের পর স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, দুর্নীতি, ইত্যাদি প্রশ্নে বেশি সোচ্চার, তাদের মাঝে এই প্রবণতা একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। তারা কথায় কথায় এমনকি যারা আওয়ামী ঘরানার হয়েও, বিগত সরকারের কাজের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমালোচনা করতেন, তাদেরও এহেন তকমা দেওয়া হচ্ছে।
আমি নিজে আওয়ামী ঘরানার অনেক শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে দেখেছি শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে। মনে রাখতে হবে, বিরোধী জোট আন্দোলনে নেমেছে অনেকাংশেই তারা আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বলে। কিন্তু আওয়ামী ঘরানার যারা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, তারা বৈষম্য ও অনাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন মূলত ন্যায্যতার প্রশ্নে এবং মানবিক তাড়নায়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সফল পরিণতিতে রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্য দিয়ে বিপরীত মতের মানুষকে খারাপ তকমা দেওয়ার এ নেতিবাচক ধারার অবসানের সুযোগ এসেছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন না হলে বাকি সব পরিবর্তনের সুফল টেকসই হবে না। পরিস্থিতি তথৈবচ হতে বাধ্য। এ সুযোগ বারবার আসবে না। এ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলে দেশ আবারও পিছিয়ে পড়বে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের লক্ষ্য দুর্নীতিমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও সমতাভিত্তিক সমাজ। আমাদের একাত্তরের চেতনাও তাই। যারা প্রকৃতই একাত্তরের চেতনা ধারণ ও লালন করেন, তাদের সঙ্গে বিগত সরকারের চিন্তা ও কাজের দিক থেকে দূরত্বও ছিল অনেক। সরকারি সুযোগ-সুবিধা, পদপদবিলোভী আওয়ামী লীগার আর প্রকৃত আওয়ামী লীগার এক নয়। একাত্তরের চেতনার আওয়ামী লীগ আর ২০১৪-পরবর্তী আওয়ামী লীগ এক নয়। এই পার্থক্য বুঝতে না পারলে অবিচারের আশঙ্কা থেকে যাবে। কেউ সরাসরি দুর্নীতি, অপরাজনীতি বা অন্য কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত না হলে নিছক আওয়ামী লীগ করার কারণে কিংবা দলের কাছাকাছি থাকার কারণে তাকে দোসর হিসেবে দোষারোপ করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নিশ্চুপ করে দিলে সমাজে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অন্তত রাজনীতিতে ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। রাষ্ট্র পরিচালনায় যে বা যে দলই থাকুক না কেন, বিরোধী মতের মানুষকে চুপ করিয়ে না দিয়ে সক্রিয় থাকা এবং গঠনমূলক সমালোচনার দ্বার উন্মুক্ত রাখা সরকারকে সঠিক পথে থাকার জন্যই প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারার পরিণতি যে কী ভয়াবহ হতে পারে, তা আগস্টের ৫ তারিখে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এই ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান থেকে আমাদের সবার শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
যারা আওয়ামী লীগের শাসনামলে অবহেলিত ছিল, তারা যদি এই সময়েও নেতিবাচক তকমার শিকার হন তাহলে তাদের ওপর অবিচার করা হবে। আওয়ামী লীগ ঘরানার হয়েও যারা আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করেছেন এবং যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আন্দোলনের শুরু থেকে সোচ্চার ছিলেন, এমন আচরণ তাদের প্রাপ্য নয়। সর্বোপরি এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে যারা বিগত সরকারের সমালোচনা করত না, এমনকি আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেনি সেই সব মহল। নব্য আওয়ামীবিরোধিতার নামাবলি গায়ে দিয়ে তারা এ সুযোগ সন্ধানে নেমে পড়তে পারে। আওয়ামীবিরোধী হলেই কেউ নিরপেক্ষ হবে, তা ঠিক নয়। নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হয়। আর দল করেও বস্তুনিষ্ঠ অবস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। তাই কাজ ও ভূমিকা দ্বারা ব্যক্তির অবস্থান ও মূল্যায়ন হওয়া একান্তভাবে কাম্য।
ট্যাগ দেওয়া বা অযথা দোষারোপের নেতিবাচক দিকগুলো সমাজে বিভাজন এবং সামাজিক সম্পর্কের অবক্ষয় সৃষ্টি করে। সমাজ গবেষকদের মতে (যেমন- এরভিং গফম্যান, ভিক্টর টার্নার), সমাজে কিছু ব্যক্তিকে ‘কলঙ্কিত’ করে তাদের সামাজিক মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে প্রান্তিক করে। এরূপ দোষারোপের ফলে সামাজিক সংকট ও বিভাজন তৈরি হয়, যা সামাজিক অস্থিরতা এবং সহিংসতার জন্ম দিতে পারে।
দেশে সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত সব খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য যতটা সম্ভব সবার অন্তর্ভুক্তি আবশ্যক। ‘ঠক বাছতে গাঁ উজাড়’ তথা উল্লেখযোগ্য একটা অংশকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র গঠন সফল ও সার্থক হবে না। সবাইকে নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে : যখন কিনা আমাদের সবার স্বপ্ন–বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়বিচার, জবাবদিহি, গণতান্ত্রিক ও সমতাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক সমাজ। বিগত সরকারের নেতিবাচক তকমার ফল আজকের বাংলাদেশ। তার সেই দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে দেশকে মুক্তি দিতে হবে জনস্বার্থেই।
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
"