এম এম শহিদুল হাসান
মতামত
সামাজিক পরিবর্তনে শিক্ষার রূপান্তর জরুরি
শিক্ষা সমাজের পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় ক্রমাগত পরিশীলিত হয়। ফলে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের একাডেমিক ব্যবস্থা সমন্বয় করতে হয়। তবে এই সমন্বয়ের গতি সমাজের অগ্রগতির হারের ওপর নির্ভরশীল। এই প্রক্রিয়ায় স্থবিরতা সাধারণত একটি দেশের শাসন ব্যবস্থার গভীরতর সমস্যার প্রতিফলন ঘটায়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশের যখন জন্ম হয়, তখন বিশ্ব তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের (১৯৫৭-২০০০) মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আজ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেও দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় বলতে গেলে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আমরা দেখছি না। এই স্থবিরতা বিশেষ করে অন্যান্য এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করলে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যারা তাদের সমাজের পরিবর্তিত চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এটি আমাদের জন্য শুধু উদ্বেগের বিষয় নয়, বরং এর অন্তর্নিহিত কারণ চিহ্নিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে কার্যকর পরিবর্তন আনতে হলে প্রথমে আমাদের জানা প্রয়োজন, বিশ্বব্যাপী শিক্ষা কীভাবে সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে চলে।
কৃষিবিপ্লব এবং পরবর্তী তিনটি শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো যেমন পরিবর্তিত হয়েছে, তেমনি শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং উদ্দেশ্যও সমানতালে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রাথমিক কৃষিভিত্তিক সমাজগুলোতে শিক্ষা ছিল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী যুক্ত। সেই সময়ে জ্ঞান মৌখিকভাবে আচার-অনুষ্ঠান, মিথ ও গল্পের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরিত হতো, যা সামাজিক বন্ধন শক্তিশালী করত। সমাজ যত সম্প্রসারিত এবং শ্রমের ক্ষেত্রগুলো যত বিশেষায়িত হয়েছে, ততই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকাশ ঘটেছে। তবে এই শিক্ষা প্রায়ই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকত, যেখানে পুরোহিত ও ধর্মযাজকদের নির্দিষ্ট কারুশিল্প এবং দায়িত্ব পালনের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। শিল্পবিপ্লবগুলোর ফলে শিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। কৃষিভিত্তিক জীবন থেকে শিক্ষার গুরুত্ব ধীরে ধীরে সাক্ষরতা, প্রাথমিক বিজ্ঞান এবং কারখানার কাজে প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক দক্ষতার দিকে স্থানান্তরিত হয়। দক্ষ কর্মশক্তির ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে গণশিক্ষার প্রসারও দ্রুত ঘটে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্ভব প্রথম শিল্পবিপ্লবের (১৭৬০-১৮৭০) অনেক আগেই হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের সময় (১৮৭০-১৯১৪); যখন ইস্পাত, বিদ্যুৎ এবং তেল শিল্প বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথ তৈরি করে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মানিয়ে নিতে চাপ দেওয়া হয় এবং তারা সমাজের পরিবর্তিত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ব্যবসায় প্রশাসনের মতো প্রোগ্রাম চালু করে। এসব পরিবর্তনের পরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূলত নিজেদের জ্ঞানের ‘আইভরি টাওয়ার’ হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ছিল, যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান শিল্পের সরাসরি প্রয়োগের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেত। অবশ্য তাদের অনেক গবেষণা শিল্পের আধুনিকায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সমাজের বাস্তবমুখী ও কর্মসংস্থানযোগ্য দক্ষতার চাহিদা তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সময় তীব্র হয়ে ওঠে। ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা কী’- এই প্রশ্ন তখনকার বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ১৮১১ সালে জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত এলিট হুম্বোল্টীয় বিশ্ববিদ্যালয় মডেলটির কার্যকারিতা কমতে শুরু করে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সময়ে অর্থাৎ ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে সমাজের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সব শ্রেণির মানুষের জন্য শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ চালক হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন নতুন প্রোগ্রাম অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে পাঠ্যক্রম প্রসারিত করে শিল্পের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্য আনে এবং শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের উপযোগী দক্ষতা প্রদানকে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে।
চলমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের বিপ্লব। কারণ এটা ডিজিটাল, ফিজিক্যাল এবং বায়োলজিক্যাল সিস্টেমের সমন্বয়ে গঠিত, যা শিল্প, অর্থনীতি এবং সমাজের কাঠামোকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করছে। শিল্প খাতে স্মার্ট কারখানাগুলো এখন সাধারণ হয়ে উঠেছে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট অব থিংকস উৎপাদন দক্ষতা বাড়িয়ে তুলছে। মেশিনগুলো একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ, স্বনিরীক্ষণ এবং বাস্তব সময়ে অপারেশন অপ্টিমাইজ করতে সক্ষম হচ্ছে। এই যুগে রুটিনভিত্তিক চাকরিগুলো দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে এবং প্রযুক্তিগত উন্নতি ও বৈশ্বিক আন্তঃসংযুক্ততার গতির কারণে ভবিষ্যতের চাকরির ধরন অনুমান করাও ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। আমরা কীভাবে এমন কিছু পরিকল্পনা করব, যা পূর্বানুমান করাই অসম্ভব? এটাই আজকের শিক্ষাক্ষেত্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এই যুগের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, শ্রমবাজারে ইংরেজি ‘টি আকৃতির’ পেশাজীবীদের প্রতি ক্রমবর্ধমান চাহিদা। এটি এমন ব্যক্তিদের বোঝায়, যাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তর জ্ঞান থাকে (‘টি’-এর অনুভূমিক অংশ দ্বারা উপস্থাপিত) এবং থাকে নির্দিষ্ট কোনো ক্ষেত্রে গভীর দক্ষতা (‘টি’-এর উল্লম্ব অংশ দ্বারা উপস্থাপিত)। আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল ও আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে কর্মীদের কেবল নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে গভীর দক্ষতাই নয়, বরং নানা ক্ষেত্রের সঙ্গে সহযোগিতা করা এবং বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও প্রয়োজন। প্রথাগত শিক্ষা, যা মূলত নির্দিষ্ট দক্ষতা শেখায়; শিক্ষার্থীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে সক্ষম নয়। এখন প্রয়োজন বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা, যেমন আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা, সমস্যা চিহ্নিতকরণ, সহানুভূতি এবং স্থিতিস্থাপকতা। এসব দক্ষতা সাধারণত লেকচার বা পরীক্ষার মাধ্যমে শেখানো সম্ভব নয়। বরং এগুলোর জন্য অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষা এবং ব্যক্তিগত সচেতনতা জরুরি। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ‘দক্ষতা প্রথম’ চিন্তাভাবনা থেকে ‘প্রক্রিয়া প্রথম’ মানসিকতার দিকে পরিবর্তিত করতে হবে, যেখানে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং অভিযোজনযোগ্যতার
ওপর জোর দেওয়া হবে। এর মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের গতিশীল ও পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে সফল হতে পারবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শিক্ষাক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। তবুও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই পরিবর্তনের প্রতি নির্লিপ্ত অবস্থানে রয়েছে। পরিবর্তন না হওয়ার পেছনে একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে আমার কাছে তিনটি প্রধান কারণ প্রতীয়মান। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অতিরিক্ত সম্পৃক্ততা একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক শিক্ষকের মূল মনোযোগ তাদের একাডেমিক দায়িত্ব পালনের চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের দিকে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের শিক্ষাক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রবণতা এবং গবেষণার সঙ্গে একটি ব্যাপক বিচ্ছিন্নতা রয়েছে, যা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতার দিকে নিয়ে গেছে। তৃতীয়ত, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হয়েছে, যা সমাজকে অর্থবহ পরিবর্তনের দাবি করতে অনীহা তৈরি করেছে। এখন আমাদের যা প্রয়োজন তা কেবল প্রশাসনিক সংস্কার নয়, বরং একটি জবাবদিহির ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক রূপান্তর, যা যুগের চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এ লক্ষ্যে একটি শিক্ষাবিষয়ক কমিশন গঠনের যৌক্তিক দাবি তোলা যেতেই পারে। পরিবর্তনের সময় এখনই।
লেখক : প্রাক্তন উপাচার্য, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
"