মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমাজ গড়তে হবে
চট্টগ্রামে ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর মুক্তি দাবিতে আন্দোলনকারীদের হামলায় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহতের ঘটনা সমাজের ক্রমবর্ধমান সহিংসতার চিত্র তুলে ধরেছে। গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী একটি রাষ্ট্রে এমন বর্বরতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ঘটনাটি শুধু আইনশৃঙ্খলার অবনতি নয়, বরং সমাজে উগ্রতা, অসহিষ্ণুতার দৃষ্টান্তও বটে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘ছাত্র-জনতা এবং হিন্দু-মুসলিমসহ জাতি-ধর্মনির্বিশেষ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’ যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামও সবাইকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানিয়েছেন। অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করাই এখন সরকারের প্রধান দায়িত্ব। অপরাধীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রামের টাইগারপাসে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং অন্যান্য সংগঠনের প্রতিবাদ ও দাবিগুলো থেকে স্পষ্ট, সাধারণ মানুষ সরকারের পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে আছে। আইনজীবী আলিফের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইসকনের মতো ধর্মীয় সংগঠনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ধর্মীয় সংগঠনগুলো যখন সহিংসতার আশ্রয় নেয় এবং রাজনীতিকরণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন সেটি শুধু আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় না, বরং সামাজিক সম্প্রীতিকেও ধ্বংস করে। এ ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে, ধর্মের নামে উগ্রতা ও সহিংসতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না।
যে জাতি ধর্মীয় সহাবস্থান এবং মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করে, তাদের জন্য এ ধরনের ঘটনা গভীর চিন্তার বিষয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অন্য নেতারা যে ঐক্যবদ্ধ থাকার এবং সব ধর্মের অধিকার রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন, তা অত্যন্ত সময়োপযোগী। এ ধরনের আহ্বান শুধু সহিংসতার অবসান নয়, বরং সামগ্রিক সামাজিক উন্নয়ন এবং সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। এ হত্যাকাণ্ডের বিচারপ্রক্রিয়াকে দ্রুত এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এটি অন্যদের জন্য ভয়ানক বার্তা হয়ে দাঁড়াবে। একই সঙ্গে সরকারের উচিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পুনর্গঠন করা। কারণ, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো এবং উসকানি দেওয়ার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত। উগ্রপন্থা এবং সহিংস রাজনীতি প্রতিরোধে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নই একমাত্র উপায়।
সাম্প্রতিক এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় উগ্রতা এবং রাজনীতিকরণ নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। ধর্মের নামে সহিংস কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সংগঠনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকাণ্ড শুধু আইনশৃঙ্খলার অবনতিই ঘটায় না, বরং সামাজিক সম্প্রীতিও ভঙ্গুর করে তোলে। এই মুহূর্তে অপরাধ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে একতা, ধৈর্য এবং মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ার জন্য আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। শহীদ সাইফুল ইসলাম আলিফের রক্ত অর্থবহ হবে তখনই, যখন আমরা এই সহিংসতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পাব এবং ন্যায়বিচার ও সহনশীলতার পথে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ব। এটি শুধু সরকারের নয় বরং পুরো জাতির দায়িত্ব।
"