মোস্তফা কামাল

  ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

মতামত

ব্যবসায়ীদের অস্বস্তিতে অর্থনীতির অস্থিব্যথা

দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়, মূল্যস্ফীতি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, শেয়ারবাজার ডুবে যাচ্ছে- এগুলো নতুন করে বলার বিষয় নয়। কোনো দেশের অর্থনীতির হালদশা বোঝার মাপকাঠি হলো- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ক্যাপিটাল মার্কেটের স্বাস্থ্যগত অবস্থা। মূল্যস্ফীতিতে আমরা এক চরম বাজে অবস্থা পার করছি। খেলাপি ঋণ পরিস্থিতিও যাচ্ছেতাই। এর সিংহভাগ বৃহৎ শিল্প খাতে দেওয়া। সরকারের নানা চেষ্টায় এর সামান্য কিছু অংশ ছাড়া বাকি ঋণ আদায় অসম্ভব পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। টেনে আনতে ছিঁড়ে যায় অবস্থা। এ দেশে বরাবরই কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব শিল্পঋণ ঝুঁকিপূর্ণ।

ব্যাংকগুলো স্বল্প মেয়াদে ঋণ নেয় তিন থেকে পাঁচ বছরের হিসাবে। এর বিপরীতে শিল্প ঋণের মেয়াদকাল ১৫-২০ বছর হয়। যথাযথসহ জামানত নেওয়া সম্ভব হয় না। তা ছাড়া ঋণ দেওয়া-নেওয়ার কালে বড় অঙ্কের অবৈধ অর্থের লেনদেন হয়। এরাই ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়। ইচ্ছাকৃত ছাড়াও ব্যবসায়িক মন্দা, বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা, সরকারের অসামঞ্জস্যপূর্ণ নীতির কারণে অনেকে খেলাপি হয়। এর বিপরীতে ক্ষুদ্র ও মাইক্রো লেভেলের শিল্প ব্যবসায় ঋণ আদায়ের হার ৯৮ শতাংশের ওপরে। শিল্পঋণের বিকল্প হতে পারত ভাইব্রান্ট ক্যাপিটাল মার্কেট গঠন। পৃথিবীর সব দেশ যে কারণে এমন শেয়ার মার্কেট গঠনে উদ্যোগী হয়। শ্রীলঙ্কা এটা বুঝেছিল। তাই অর্থনীতির চেহারা ফেরাতে তাদের বেশি সময় লাগেনি। এখানে ১৮ লাখ বিনিয়োগকারীর ৭০-৮০ শতাংশ পুঁজিই হাওয়া। যার কারণে পুঁজিবাজারের যাচ্ছেতাই অবস্থা।

অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, অর্থনীতির অবস্থা ভয়াবহ। চ্যালেঞ্জের মুখে ব্যাংক খাত, পুঁজিবাজার ও রাজস্ব আদায়। সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা ব্যাংক খাতের আমানতকারীদের আমানত সুরক্ষাসহ কোনো ব্যাংক বন্ধ না হওয়ার ঘোষণা দিলেও পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের পুঁজির সুরক্ষার দিকটা উহ্যই থেকেছে। আবার এ কথাও সত্য, নতুন শেয়ার আনার দায়িত্ব সরকারের নয়। বিএসইসিরও নয়। এ কাজ স্টক এক্সচেঞ্জের, মার্চেন্ট ব্যাংক ও ইস্যু ম্যানেজারদের। সেখানেও ফাঁকিবাজি। সঙ্গে ধরিবাজিও। এ দশায় কিছুসংখ্যক বাদ দিলে বনেদি-জাত ব্যবসায়ীরা ভীতসন্ত্রস্ত। নানামুখী চাপে চ্যাপ্টা তারা। ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, আইনশৃঙ্খলায় অস্বস্তিসহ নানা কারণে উৎপাদনে ভর করেছে গতিহীনতা। তার ওপর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কারখানায় হামলা, হয়রানিমূলক মামলা, ব্যাংক হিসাব জব্দ, বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞাসহ নতুন যন্ত্রণায় তারা ভীতসন্ত্রস্ত। আত্মরক্ষায় কেউ ধীরে চলছেন।

নতুন বিনিয়োগের চিন্তায় না গিয়ে বিনিয়োগ, যা আছে সেটা টেকানোর চেষ্টা করছেন। জাত ব্যবসায়ীদের অনেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেছেন। দীর্ঘ পরিশ্রমে ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন। এতে বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর অনেক কারখানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। হামলার ভয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও অনেক ব্যবসায়ীকে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় আমদানি-রপ্তানি বা বিনিয়োগ-সংক্রান্ত জরুরি কাজেও অনেক ব্যবসায়ী বিদেশে যেতে পারছেন না। ৫০ বছর ব্যবসা করেও যিনি ঋণখেলাপি হননি, নানাভাবে চাপের মুখে ফেলায় তারও ব্যাংকের কাছে ঋণখেলাপি হওয়ার উপক্রম।

আগের সরকারের দোসরদের মধ্যে অনেক বড় ব্যবসায়ী ছিলেন- আছেন, তাও সত্য। তাদের অনেকে আগেভাগে পালিয়েছেন। যারা কোনোমতে টিকে আছেন, তারাও বুঝতে পারছেন না আগামী এক-দেড় বছরে রাজনীতি কোন দিকে যাবে। কারা ক্ষমতায় আসীন হবে- সেই হিসাবও করতে হচ্ছে। তাদের এই পেরেশানি থেকে মুক্ত করতে হবে। নিশ্চয়তা দিতে হবে- সরকারে যেই থাক, যেই আসুক তাদের কোনো সমস্যা হবে না। এ দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। ব্যবসায়ী নয়, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নির্ভরযোগ্য ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিতও করতে হবে। জ্বালানি খাতের দুর্নীতির কারণে মূল্য বৃদ্ধি পায়, যা ভোক্তা বা ব্যবসায়ীর ঘাড়ে পড়ে।

আর্থিক খাতের দুর্দশাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। করনীতিতেও সংস্কার জরুরি। কর প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ব্যবসা শুরুর নিয়মকানুনও সহজ করতে হবে। ব্যবসা শুরু করতে বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে নিবন্ধন নিতে গিয়ে উদ্যোক্তাদের পদে পদে হয়রানির লাগাম টানতে হবে। ব্যবসায়ীদের মুখস্থ গাল দেওয়া সহজ। টানা পরিশ্রম এবং বিপুল বিনিয়োগে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার মাধ্যমে তারা যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, গাল দেওয়ার সময় তা মনে থাকে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মতে, দেশে মোট কর্মসংস্থানে সরকারি চাকরির অংশ ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, বেসরকারি চাকরির অংশ ১৪ দশমিক ২ এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিয়োজিত ৬১ শতাংশ কর্মী। এখন সেখানে নতুন কর্মসংস্থান দূরে থাক, কর্ম আরো যায়-যায়।

সাধারণত রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় বিনিয়োগ কম হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরে এই প্রবণতা দেখা যায়। এ বছরের ৭ জানুয়ারি একতরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানে দেশ আরো অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটেনি। একেক দিন একেক শ্রেণিগোষ্ঠী নানা দাবিতে মাঠে নামছে। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ আশা করার কারণ নেই। আগে করা বিনিয়োগ টেকানোই কঠিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে, যা ২৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১৮৬টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। টাকার অঙ্কে যা ১৯ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। আগের তিন মাসের (এপ্রিল-জুন) তুলনায় ৪ ভাগের ১ ভাগ। ওই সময়ে ২৫৪টি প্রতিষ্ঠান ৭৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রস্তাব মানেই প্রকৃত বিনিয়োগ নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, এক দশক ধরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিনিয়োগ ২২-২৩ শতাংশেই ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছিল ৭ শতাংশের বেশি। বিনিয়োগ-প্রবৃদ্ধি না থাকলে বেকারত্ব বাড়বে- তা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়া লাগে না। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রতি বছর শ্রমবাজারে ২০-২২ লাখ তরুণ নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে ১২-১৩ লাখের দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয়; আর প্রতি বছর ৮-৯ লাখ মানুষ বিদেশে যান।

গত তিন মাসে বেকারত্বের পরিস্থিতি কী দাঁড়িয়েছে, তা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করেনি বিবিএস। বেকারত্বের তথ্য-উপাত্ত তাই পুরোনো। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, তখন দেশের বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৮২ হাজার। এই বেকার তরুণ-তরুণীর মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আছেন ৭ লাখ ৯৯ হাজার। এর মানে হলো, মোট বেকারের প্রায় ৩১ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। দেশের মোট বেকারের ৮৩ শতাংশের বয়স ১৫-২৯ বছর। অন্যদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখের মতো হলেও পছন্দমতো কাজ পান না প্রায় পৌনে এক কোটি তরুণ-তরুণী। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে যে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার পেছনেও ছিল কর্মসংস্থানের সংকট। সেই আন্দোলনে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হলে তা রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে।

বর্তমান পরিস্থিতির ধরনটা ভিন্ন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতা ও তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীর বেশির ভাগ আত্মগোপনে অথবা কারাগারে। ফলে তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো চাপে রয়েছে। দেশের বড় কিছু শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো যাতে সচল থাকে, কর্মীরা বেতন-ভাতা পান, সে ক্ষেত্রে সরকারের একটি কৌশল থাকতে পারে। এটি হবে একটি কাজের কাজ। এ ছাড়া এমন একটা নিদানকালে সরকারি ব্যয় এবং কাজকর্মে কৃচ্ছ্রসাধন দরকার। বিগত সময়ে সব রাজস্ব আয় চলে যেত রাজস্ব ব্যয়ে। উন্নয়নের টাকার জোগাড় হতো ধার করে। এখনো কি এর ব্যত্যয় হয়নি।

তিন-সাড়ে তিন মাসে দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি বদলে যাবে, এমনটা কেউ প্রত্যাশা করে না। দেশের অর্থনীতির চেহারা পুরোপুরি পাল্টে যাবে- প্রত্যাশার পারদ এমনও নয়। কিন্তু কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তন এ সময়ের মধ্যে প্রত্যাশা করা অমূলক নয়। তিন মাসে খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের বাজার ব্যবস্থা, ডলার মূল্যে স্থিতিশীলতা আর শেয়ারবাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা কি একেবারেই অসম্ভব ছিল? বিশ্ববাজার তো মোটামুটি স্থিতিশীল? রেমিট্যান্স আর বৈদেশিক বাণিজ্য ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে। অথচ গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা গত মাসের চেয়ে বেশি। শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছিল। এখন তা মাইনাস ৫ শতাংশ। তাদের শেয়ারবাজারের ইন্ডেক্স বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ওরা পারলে আমরা পারছি না কেন? তারা সরকার পরিচালনাকে প্রশাসনিক কাজের চেয়ে বেশি ভেবেছে ব্যবস্থাপনার কাজ হিসেবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ বাংলাভিশন

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close