সোহানুর রহমান
মুক্তমত
ঘোড়ার গাড়ির নামে প্রাণী নির্যাতন বন্ধ করুন
প্রাণীর প্রসঙ্গ মাথায় আসলেই স্বামী বিবেকানন্দের সেই উক্তিটি মনে পড়ে যায়। তিনি বলেছিলেন ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ কথাটির মর্মার্থ হচ্ছে জীবের আত্মারূপে স্রষ্টা জীবের মধ্যে অবস্থান করেন। তাই জীবের সেবা করলেই স্রষ্টার সেবা করা হয়। বস্তুত জীবের প্রতি আন্তরিক না হয়ে স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করা যায় না। সৃষ্টিকে ভালোবাসার মাধ্যমেই কেবল স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা যায়। আজকাল মানুষ এই উক্তি মানে না।
পয়সা উপার্জন মানুষের কাছে এখনকার যুগে বড়। পয়সা উপার্জনের জন্য মানুষ নিজেকে পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে রাজি। এ রকমই একটি পয়সা উপার্জনের পন্থা ঘোড়ার গাড়ি ‘টমটম’। উপার্জনের কথাটা যদিও ঢাকা পড়ে যায় ঐতিহ্যের কাছে। কিন্তু ঐতিহ্য মানে কি প্রাণীর ওপর অমানবিক নির্যাতন। ঘোড়ার গাড়ির টমটম যেন সে কথায় বারবার বলে। ঐতিহ্যের নাম ভাঙিয়ে একশ্রেণি দিব্যি পয়সা কামিয়ে যাচ্ছে। আর এদিকে অসহায় বোবা প্রাণীগুলো বলতেও পারছে না তাদের কষ্টের কথা, বুক ফাটা কান্নার কথা।
ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু হয় ১৮৩০ সালে। তখন এ দেশে ছিল নবাবি শাসন। পুরান ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘোড়ার গাড়ি চলত। সে হিসেবে পুরান ঢাকায় প্রায় পৌনে দুইশ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এই টমটম। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী-১’ বই সূত্রে জানা যায়, আর্মেনীয়রা ১৮ শতকের প্রথম দিকে ঢাকায় বসবাসকারী প্রভাবশালী সম্প্রদায় ছিল। ব্যবসার উদ্দেশে তারা সে সময় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দোকান খুলেছিল। তার মধ্যে শাঁখারীবাজারের ‘সিরকো অ্যান্ড সন্স’ অন্যতম। এ দোকানে বিভিন্ন ইউরোপীয় জিনিসপত্র বিক্রি হতো। ‘মেসার্স আনানিয়া অ্যান্ড কোম্পানি’ ছিল প্রতিষ্ঠিত মদ ব্যবসার প্রতিষ্ঠান। ১৮৫৬ সালে সিরকোই প্রথম ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন করেন, যা ‘ঠিকা গাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। তখন সিরকোর ঠিকা গাড়ির ব্যবসা বেশ জমে উঠেছিল। সময় গড়িয়ে তা হয়ে ওঠে ঢাকার প্রধান বাহন। ১৮৬৭ সালে ঠিকা গাড়ির সংখ্যা ছিল ৬০। ১৮৮৯ সালের দিকে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬০০টি।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের এক হিসাবে দেখা যায়, ১৮৬৭ সালে ঢাকার রাস্তায় মাত্র ৬০টি ঘোড়ার গাড়ি চলাফেরা করত। ১৮৭৪ সালে বেড়ে হয় ৩০০টি। আর ১৮৯০ সালে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। নাজিরাবাজার, সিদ্দিকবাজার, চকবাজার, বাংলাবাজার, ফরাশগঞ্জ, মালাকার টোলার অন্তত ৫০ জন কোচোয়ান একটি সমিতি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ১৯৪০ সালের দিকে, যার নেতৃত্বে ছিলেন সিদ্দিকবাজারের মতি সর্দার। এ সমিতি গড়ে তোলার উদ্দেশ্য ছিল পুলিশি জুলুম থেকে নিজেদের রক্ষা করা। সময়ের ব্যবধানে ঢাকার রাজপথ বর্তমানে মোটরগাড়ি আর রিকশার দখলে। এর পরও ঘোড়ার গাড়ি রাস্তা থেকে একেবারে হারিয়ে যায়নি।
প্রশ্ন আসতে পারে প্রাণীর ওপর অমানবিক নির্যাতনে রুখতে কি কোনো আইনত পদক্ষেপ আছে? উত্তরে বলব পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করার জন্য বাংলাদেশে দুটি আইন আছে। একটি হলো ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন। আইনটি প্রথম গৃহীত হয় ১৯৭৩ সালে; ২০১২ সালে সর্বশেষ সংশোধিত আইনটিতে বন্যপ্রাণী হত্যার দায়ে এক বছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান আছে। অন্য আইনটি ১৯২০ সালের পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা নিরোধ আইন। এ আইনেও কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু আমরা তো নিজের স্বার্থ রক্ষা ছাড়া আর কোনো কিছুই কখনো দেখি না। তা ছাড়া দুটি আইনই ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে; বস্তুত দেশের অধিকাংশ মানুষেরই এ দুটি আইন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।’
কখনো ভেবে দেখেছেন, দুটো ছোট্ট প্রাণী কতটা ভার সহ্য করতে পারে? তাদের দুঃখের কথা চিন্তা করার মানুষ যেন সব ঘুমিয়ে আছে। ঘোড়াগুলোর চোখ যেন বারবার বলে আমরা মুক্তি পাব কবে। এর বিরুদ্ধে কি আমাদের কিছুই করার নেই? নাকি করার থাকলেও তাদের নিয়ে ভাবার কোনো সময় নেই আমাদের হাতে। অবুঝ বোবা প্রাণীগুলো অসহায়ত্ব বরণ করে নিয়ে টেনে বেড়াচ্ছে ভারের বোঝা। আমাদের বসে থাকলে চলবে না প্রাণিকুলের প্রতি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়ানোর জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। ঘোড়ার গাড়ি চালানোর জন্য প্রাণী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ঘোড়ার প্রতি খারাপ ব্যবহার ও অত্যাচার হলে তা অবিলম্বে শাস্তিযোগ্য হতে হবে। ঘোড়াদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখা উচিত। তারা যেন পর্যাপ্ত বিশ্রাম, খাবার, পানি ও চিকিৎসাসেবা পায়, তা নিশ্চিত করা উচিত। জনসাধারণের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ যেন জানে, ঘোড়ার গাড়ির মাধ্যমে প্রাণী নির্যাতন কীভাবে ঘটছে এবং এটি কতটা নিষ্ঠুর, তা বুঝতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া, প্রতিবাদ এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে। এগুলো যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে ঘোড়ার গাড়ির মাধ্যমে প্রাণী নির্যাতন অনেকটাই কমানো সম্ভব হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
"