ফয়সাল বিন লতিফ
দৃষ্টিপাত
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন ও আমাদের প্রত্যাশা
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অপরিহার্য। একটি দেশের নির্বাচনব্যবস্থা গণতন্ত্রের মাপকাঠি স্বরূপ। সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনমতের প্রতিফলন ঘটে এবং জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশে নির্বাচনী সংস্থা হলো নির্বাচন কমিশন। বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন হচ্ছে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে থেকে যেকোনো ধরনের হস্তক্ষেপ মুক্ত থেকে দায়িত্ব পালন করা উচিত। বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান গণতান্ত্রিক দেশে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বারোটি জাতীয় নির্বাচন, তিনটি গণভোট, তিনটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসহ অনেকগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সামরিক-বেসামরিক আমলের সব নির্বাচন নিয়েই কিছু না কিছু বিতর্ক থাকলেও বিগত সরকারের অধীনের তিনটি নির্বাচন ছিল সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবোধক।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কয়েক দফায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে বৈঠক করে। সেসব বৈঠকসহ বিভিন্ন সভা-সমাবেশে রাষ্ট্রের নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করতে সরকারকে তাগিদ দেয় রাজনৈতিক পক্ষগুলো। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি তার প্রশাসনের প্রথম ১০০ দিনের স্মরণে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছেন। তার বক্তৃতার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল-দেশের নির্বাচনের সময়সূচি। এটি এমন একটি বিষয়, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বৃত্ত এবং জনসাধারণের মধ্যে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে উত্তেজনা দূরীকরণ, রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলা এবং অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের পথ নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ও জনমনে আস্থার সংকটের প্রেক্ষাপটে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ পেয়েছেন এ এম এম নাসির উদ্দীন। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব। কমিশনার পদে যে চারজন নিয়োগ পেয়েছেন তারা হলেন- অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব তহমিদা আহমদ এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। নতুন নির্বাচন কমিশনের সামনে দায়িত্ব পালন করার জন্য নিরপেক্ষতা, দক্ষতা এবং দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করা অপরিহার্য। তারা যদি আস্থাশীল ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে পারে, তবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। তবে এর জন্য কমিশনকে সাহসিকতা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এ সরকারের অধীনে একটা ভালো নির্বাচন করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে যেহেতু এ নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা উচিত। গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বেচ্ছায় ভোটার উপস্থিতির দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমেই জবাবদিহিমূলক সরকার গঠিত হতে হবে। এ জন্য গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিবর্গ দ্বারা গঠিত নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই।
নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বলেছেন, মানুষ যাতে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে। তিনি বলেন, ২০১৪ সাল থেকে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছে। এই আন্দোলনের মূল বিষয়ই ছিল ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। এত মানুষের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা সম্ভব নয়। সে জন্য সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাব। আমরা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এই বক্তব্যের সঠিক বাস্তবায়ন দেখতে চাই।
সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের প্রতি জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশা থাকবে অনেক। তবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের মুখোমুখি হতে হবে একাধিক চ্যালেঞ্জের। বাংলাদেশের বর্তমান নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মধ্যে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। নতুন নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ও চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো উঠে আসে :
নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা : নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য করার জন্য নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করা ইসির প্রধান দায়িত্ব। এ জন্য তাদের ভোটার, রাজনৈতিক দল এবং প্রশাসনের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে হবে।
নিরপেক্ষতা বজায় রাখা : নির্বাচন কমিশনকে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি নিরপেক্ষ থাকতে হবে এবং তাদের আচরণবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ করা : নির্বাচনব্যবস্থাকে আরো স্বচ্ছ করতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। ইভিএম বা অনলাইন ভোটার নিবন্ধনের মতো ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।
সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা : সব রাজনৈতিক দল যাতে নির্বাচনে অংশ নেয় এবং তা বর্জন না করে, সেটা নিশ্চিত করাও কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব।
রাজনৈতিক চাপ : নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক চাপমুক্ত থেকে কাজ করতে হবে, যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন : জনগণের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ববর্তী কমিশনগুলোর বিতর্কিত ভূমিকা বর্তমান কমিশনের কাজকে আরো কঠিন করে তুলেছে।
নির্বাচনী সহিংসতা প্রতিরোধ : নির্বাচনের সময় সহিংসতা এবং নির্বাচনী অনিয়ম প্রতিরোধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে, গ্রামীণ এলাকায় এসব চ্যালেঞ্জ বেশি দেখা যায়।
প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ : ইভিএম ব্যবহারের পদ্ধতি ও দক্ষতা নিয়ে ভোটার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সন্দেহ আছে। এসব সন্দেহ দূর করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি।
সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক বাধা : নির্বাচনের সময় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন পাওয়া ইসির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তা ছাড়া বড় চ্যালেঞ্জ হবে নির্বাচনের সময় প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঠিকভাবে পরিচালিত করা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং ভুয়া ভোটারদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। এটি একটি কারিগরি এবং সময়সাপেক্ষ কাজ হলেও এর ওপর ভোটারদের আস্থা অনেকাংশে নির্ভরশীল। পাশাপাশি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়মনীতি মেনে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা অপরিহার্য।
আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনের জন্য বহু রকম চ্যালেঞ্জ থাকবে; সামনে আরো অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে। সেটা বিবেচনায় রেখেই নতুন নির্বাচন কমিশন কাজ করবে। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগোতে পারব বলে আমার বিশ্বাস। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন ঘটাতে হবে এবং রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। বিগত দিনে ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে সমস্যাটি নির্বাচন ব্যবস্থার মনে হলেও মূলত সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার অভাবকেই আমি দায়ী মনে করি। জনগণ তাদের রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হলে এ ধরনের পরিবর্তন সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান ভিত্তি। এটি একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে। তবে, একটি কার্যকর ও সুষ্ঠু নির্বাচন কমিশন নিশ্চিত করার জন্য নিরপেক্ষতা, দক্ষতা এবং আইন অনুযায়ী কাজ করার মানসিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং সব রাজনৈতিক দলের প্রতি সমান আচরণ করা অপরিহার্য। এ ছাড়া, ইসিকে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন রাখার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নও গুরুত্বপূর্ণ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতন হয় ৫ আগস্ট। এর এক মাস পর ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। দেড় মাস ধরে শূন্য থাকার পর এখন নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো। স্বাভাবিকভাবেই নতুন কমিশনের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা- তারা অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দেবে। কথার চেয়ে কাজে প্রতিফলনই হবে তাদের আসল চ্যালেঞ্জ এটাই আমার বিশ্বাস। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সর্বজনীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনের কোনো বিকল্প নেই। তাই এখন নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ হওয়া উচিত নির্বাচন পদ্ধতির ওপর যে গণহতাশা তৈরি হয়েছে, সেটা থেকে মানুষকে উদ্ধার করা এবং একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। সর্বশেষে, একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং দক্ষ নির্বাচন কমিশন দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সহায়ক। এ প্রতিষ্ঠানটি যদি জনসাধারণের আস্থা অর্জনে সফল হয়, তবে তা একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ গণতন্ত্রের ভিত্তি গড়ে তুলবে।
লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা, জনতা ব্যাংক পিএলসি, পটুয়াখালী
"