মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

  ২৭ নভেম্বর, ২০২৪

মতামত

দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি

যারা জটিল রাজনীতি, সমাজনীতি সামান্যতম বোঝেন না, ধার ধারেন না সহজ অর্থনীতির, এমন কারো কাছে তার জীবনের প্রধান সমস্যার কথা জানতে চাওয়া হয়, নিশ্চয়ই তিনি খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কথা নির্ভাবনায় বলে দেবেন। নিত্যপণ্যের দাম দিন দিন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কিছুতেই যেন স্থির রাখা যাচ্ছে না খাদ্যপণ্যের দাম। এক-দুদিন কমে থাকে তো তৃতীয় দিন আবার বেড়ে পূর্বের স্থানে ফিরে যায়। খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে অসহায় হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। যেকোনো শ্রেণিপেশার মানুষ আজ আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সন্তানের শিক্ষা, নিজের যাতায়াত খরচ, সংসারের যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে কষ্ট হচ্ছে বেশির ভাগ ছোটখাটো চাকরিজীবীর। শ্রমজীবীদের অবস্থা আরো করুণ। দেশের বর্তমান অবস্থায় আয় কমেছে রিকশাচালকসহ অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের। পাশাপাশি বেড়েছে ব্যয়। চাল, ডাল, আটা, ভোজ্য তেলসহ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের মূল্য লাগামহীন বৃদ্ধি পাচ্ছে বেশ কিছুকাল ধরে। দেশে যে কাঁচা মরিচ পর্যাপ্ত উৎপাদিত হয়, কিছুদিন আগে সেই কাঁচা মরিচের কেজি বেড়ে উঠে গেল কেজিপ্রতি ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে এর দাম ওঠানামা করলেও কেজিপ্রতি দুইশ টাকার নিচে আজও মিলছে না। শীত মৌসুমের শুরুতে বাজারে শাকসবজির সরবরাহ বাড়লেও প্রতি কেজি ৭০ থেকে আশি টাকায় বিক্রি হচ্ছে বেশির ভাগ সবজি। শীতের সবজির কেজি ১০০ টাকা বা তারও ওপরে। মাঝারি আকারের একটি লাউয়ের দাম ১০০ টাকা। টমেটো, গাজর ধরাছোঁয়ার বাইরে। আজকাল দেশের বেশির ভাগ মানুষ সকালের নাশতায় আটার রুটি খান। হোটেল-রেস্তোরাঁয় নানা খাবার তৈরিতে আটা লাগে প্রচুর। আটার মূল্য কেজিকে ৬০ টাকার ওপর। পণ্যমূল্য আরো বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আজকাল বাজারে বাঙালির প্রধান খাদ্যশস্য চাল প্রকারভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৯০ টাকায়। সরু চালের চেয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মোটা চালের দাম তুলনামূলক বেশি। সব ধরনের ডালের দামও চড়া। এক লিটার খোলা ভোজ্য তেলের মূল্য ১২০-১৫০ টাকা। চিনি কেজিপ্রতি ১২০-১৩০ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না। নিম্নবিত্তের মানুষ কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করছে। কবছর আগে দেশে চাল ও খাদ্যপণ্যের ব্যাপক উৎপাদনের মূল্য কিছুটা স্থিতিশীল থাকায় জনমনে কিছুটা স্বস্তি এসেছিল। কিন্তু কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কখনো অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক রাখা যায়নি। পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে বিপদে ফেলেছে। এ কথা সত্যি, দেশের একটি শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়। তাদের সংখ্যা তেমন বেশি নয়। বর্তমান দ্রব্যমূল্য দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেই। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কর্র্র্তৃক গৃহীত নানা পদক্ষেপ যেন তেমন কাজে আসছে না। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও জিনিসপত্রের দাম বাড়বে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব জিনিসের দাম কমে বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়ে না। বরং কোনো ক্ষেত্রে এর উল্টোটা হয়। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা কেউ জানেনা।

বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে চাল, ডাল, আটার ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভাতপ্রিয় বাঙালি বিপাকে পড়েছেন। আলুর বাম্পার ফলন হওয়ার পরেও কমমূল্যে দীর্ঘ সময় আলু প্রাপ্তির যে সম্ভাবনা ছিল বাস্তবে তা হয়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণ আলু পচে যাওয়ায় এবং অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের মারপ্যাঁচে পড়ে আলুর দাম বেড়ে যায়। এখন বাজারে আলুর কেজি ৭০ টাকা। হিমাগারে সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় ফি বছর প্রচুর আলু পচে যায়। এভাবে আলুর মূল্যও দীর্ঘদিন স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয় না। দেশে প্রতি বছর আলুর চাহিদা প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টন। আবার এ দেশেই প্রতি বছর আলুর চাহিদার অতিরিক্ত আলু উৎপাদিত হয়। ফলে দেশ থেকে বিদেশে আলু রপ্তানিও করা হয়। অথচ সেই আলুই কখনো দেশে চড়া মূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে। ভারত থেকে আমদানিকৃত আলু প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রির কথা থাকলে বাজারে ৬০ থেকে ৭০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। মৌসুমে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে আলুর উৎপাদন কমে গেলে চাহিদার চেয়ে জোগান কম হওয়ায় দেশে আলুর দাম বৃদ্ধি পায়। আর এর প্রভাব পড়ে খাদ্যপণ্যের বাজারের মূল্যে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে জিনিসের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

চড়া আজ মাছ, মাংসের দাম। সাধারণ মানুষের পছন্দের আমিষ এককালের সহজলভ্য গরুর মাংসের কেজি সাত শ পঞ্চাশ টাকা। খাসির মাংস হাজারের ওপরে। মাংস কেনার সংগতি হারিয়েছে নিম্নবিত্তের মানুষ। দেশে নদীর মাছের সরবরাহ কম। চাষের মাছ তেলাপিয়া বা পাঙাশের তেমন আজ কদর নেই ক্রেতার কাছে। দেশি মুরগির কেজি পাঁচ শ টাকার ওপরে। ব্রয়লারও দুই শ টাকা ছুঁই ছুঁই। ইলিশ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকে সব সময়। বছরে দুবার ইলিশ শিকার বন্ধ রেখে ইলিশের উৎপাদন বাড়লেও বাজারে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয় ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকায়। ডিমও সব সময় কম দামে পাওয়া যায় না। একবার তো চল্লিশ টাকা হালির ডিম আশি টাকা হয়ে গেল। এখনো রয়েছে আটচল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা হালি। কী খেয়ে প্রোটিন চাহিদা পূরণ করবে সাধারণ মানুষ। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ডিমের হঠাৎ এমন মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে চরম বেকায়দায় ফেলে দিল। চারদিকে শোরগোল পড়ে গেল। মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি হয়ে গেল দেশ। মাত্র কদিনে অসাধু মুনাফালোভী হাতিয়ে নেয় মোটা অঙ্কের টাকা। সয়াবিন তেল নিয়েও কখনো চলছে অসাধু কারবার। একই অবস্থা চলছে এখন পেঁয়াজ নিয়ে। আলু এবং পেঁয়াজ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শীর্ষে। প্রতিটি পরিবারে রান্নায় প্রতিদিন কমবেশি আলু ও পেঁয়াজ ব্যবহার করে থাকে। বিশ টাকা কেজি পেঁয়াজের মূল্য হয়ে গেল ১০০ বা ১২০ টাকা। হঠাৎ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে কেজিপ্রতি ১৭০ টাকা। প্রতিটি পণ্যের এ ধরনের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বাজার সিন্ডিকেট। এরা অত্যন্ত ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী। এরা যখন খুশি পণ্যের দাম বাড়িয়ে টাকা উপার্জনে সিদ্ধহস্ত। দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৭ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পেঁয়াজ দেশের মানুষের চাহিদার ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ পূরণ করে থাকে। বাকি চাহিদা বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়। পেঁয়াজের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে আমদানি শুল্ক এবং রেগুলেটরি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এর পরও পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিক থাকছে না। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, অধিক মূল্যে পেঁয়াজ আমদানি করায় স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম কমছে না।

পেঁয়াজসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ। নিত্যপণ্যে বাজারে ওঠার আগেই একাধিকবার হাতবদল হয়। এক শ্রেণির অসাধু ফটকাবাজ বিনা পুঁজিতে কামিয়ে নেয় অর্থ। পণ্য পরিবহনের পথে পথে চাঁদাবাজি পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে তাও বিশ্বাস করেন না সবাই। এর প্রভাব পড়ে বাজার মূল্যে, ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্রেতাসাধারণ। দেশে পর্যাপ্ত চাল উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও ভর্তুকি দিয়েও চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে আনা যায় না। আবার চালের দাম-বেশি কমে গেলে কৃষক পড়ে যায় মহাসংকটে। উৎপাদনব্যয়ও তারা ঘরে তুলতে পারে না। চালের বিক্রয় মূল্য দিয়েই তো দেশের কৃষক সম্প্রদায়কে তাদের জীবনের সব প্রয়োজন মেটাতে হয়। দেশের কৃষক সম্প্রদায়কে কৃষিপণ্যের আবাদে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে। দিতে হবে কৃষিঋণ সহায়তা। কৃষকের কাছে কমমূল্যে যথাসময়ে পর্যাপ্ত বীজ, সার, কীটনাশক, বিদ্যুৎ ও ডিজেল পৌঁছে দিতে হবে। খাদ্যপণ্যের দাম থাকতে হবে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ক্রয়সীমার মধ্যে। দেশের কোটি মানুষের জন্য চালসহ সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। ভেঙে দিতে হবে বাজার সিন্ডিকেট। অসাধু, মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিতে হবে আইনগত ব্যবস্থা। দেশে পণ্য ব্যবসায়ীরা পণ্য কেনাবেচায় কোনো পাকা রসিদ রাখে না। ফলে কত টাকা ক্রয়মূল্যের পণ্য কত টাকায় বিক্রি করে, কত মুনাফা লাভ করা হলো, তার হিসাব থাকে না। দোকানে প্রতিটি পণ্যের মূল্য তালিকা টানিয়ে রাখার কথা থাকলেও বেশির ভাগ ব্যবসায়ী তা মানেন না। ফলে বিক্রেতা যার কাছ থেকে যে দাম নিতে পারেন, তাই করে থাকেন। ব্যবসায়ীদের কারসাজির কাছে ভোক্তারা অসহায়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিভাগের বাজার মনিটরিংয়ে প্রায়ই এ ধরনের পরিস্থিতি লক্ষ করা যায়। মনিটরিংয়ে নিয়োজিত কর্মকর্তারা অসাধু ব্যবসায়ীদের কখনো জেল, জরিমানা করে থাকেন। কিন্তু বাজারে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে এর খুব একটা প্রভাব পড়ে না। মুক্তবাজার অর্থনীতির এ সময়ে নিশ্চিত করতে হবে খাদ্য নিরাপত্তা, বাড়াতে হবে কৃষি উৎপাদন। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যপণ্য উৎপাদিত হলে এবং বাজারব্যবস্থায় অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ হলে পণ্যমূল্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসবে। এ ছাড়া সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে ব্যবসায় নতুন সৎ ব্যবসায়ীদের আগমনে উৎসাহিত করতে হবে। বিশেষ করে, পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ বাজার মনিটরিংয়ে আরো কঠোরতা অবলম্বন এবং সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি বন্ধে তৎপরতা বাড়াতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close